সাজু আহমেদ ।। দেশের অন্যতম সৃজনশীল সাহিত্যিক আমিরুল মোমেনীন মানিক একজন সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও গীতিকবিও। ‘শুদ্ধ উচ্চারণের সংবাদকর্মী’ তকমায় ভূষিত মানিক সাহসী সাংবাদিকতায় অভূতপুর্ব সাফল্যে ঋদ্ধ। অসাধারণ মেধাবী সঙ্গীতশিল্পী এবং সৃজনশীল সাহিত্যকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সমান্তরালে। তাঁর প্রকাশিত ২০টি গ্রন্থে তীক্ষ্ন সমকালীন সমাজ বাস্তবতার দৃষ্টিভঙ্গির সরল এবং সোজা সাপটা উচ্চারণ চরম সাহসিকতারই উজ্জল দৃষ্টান্ত।
মানিক রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বশেষ প্রকাশিত ‘ফেরেশতার সুগন্ধি রুমালে আমার আত্মা’ কাব্যময়তা ও অদম্য মেধার স্ফুরণ যেন। প্রকাশক নাজমুস সায়াদাতের ‘সরলরেখা’য় প্রকাশিত গ্রন্থে চল্লিশটি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন আরেক তরুণ আলোকিত কবি আবিদ আজমকে। উৎসর্গ বচনে তরুণ এই কবির কাছে অনুপ্রেরণার দায় স্বীকারে কবিতার মতই স্পর্ধিত উচ্চারণে বলেছেন ‘আমার দেখা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যতিক্রমী এক তরুণ, যার সৃজনের জাদুস্পর্শে ফিনিক্সের মতো জেগে উঠি, বিপ্লবানন্দে নিজেকে আবিস্কার করি নতুন করে, ‘আবিদ আজম’ বৈরী বাতাসে লাগাম টেনে ধরা এই নক্ষত্রকে।’
‘ফেরেশতার সুগন্ধি রুমালে আমার আত্মা’ গ্রন্থের নামকরণ এবং সত্য ভাষণে অসাধারণ দৃঢ়তা যেন কাব্যময়তাকে গাঢ় করেছে। এক অবধারিত সত্য মৃত্যু বা পরজন্ম অথবা লোকান্তর নিয়ে যুগে যুগে কত বাণী বাক্য, বিশ্বাস অবিশ্বাস যে প্রচলিত আছে তার ইয়াত্তা নেই। কবি তার গ্রন্থ নামকরণের কবিতা ‘ফেরেশতার সুগন্ধি রুমালে আমার আত্মা’য় চিরন্তন শাশ্বত সত্যকে ভাষার কারুকার্যে, গতির সৌন্দর্যর অলংকারে খচিত করেছেন। মৃত্যুর মত চরম সত্য নিয়ে স্পষ্টবাদিতায় নিজেকে অবলীলায় সঁপে দিয়েছেন কবি। বলতে চেয়েছেন আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। তবে সেই মৃত্যু যেন হয় আমার পছন্দের সময়, সুন্দর মুহুর্তে, প্রকৃতি ও স্বজনের সান্নিধ্যে। মৃত্যুর জন্য আকণ্ঠ প্রস্তুত আমেরুল মোমেনীন মানিক কবিতার মাঝপথে ফিরে যান তাঁর জন্মকালীন স্মৃতিচারণে। বাস্তুভিটায় জন্মের দৃশ্যপটে তাঁর মা-বাবার ছবি ভেসে ওঠে, সেখানে ক্রমান্বয়ে উঠে আসে তাঁর শৈশব, কৈশর, যৌবন। এক সময় ধ্যান ভাঙ্গে কবির, তাঁর কল্পিত মৃত্যুর ফেরেশতাকে দেখে তার সুখের মরণের সাধ জাগে। সত্য, স্পষ্ট ভাষণের দায়ে বিপ্লবী ও বিদ্রোহী হয়ে বৈরী সময়ের খঞ্জরে মৃত্যুকামনায় হাহাকার করে ওঠে তাঁর মন। মোক্ষম এবং কাঙ্খিত সময়ে মৃত্যু চাওয়ার মধ্য দিয়ে যেন অনন্তকাল বেঁচে থাকারই আকুতি জানিয়েছেন কবি মানিক। তেমনিভাবে ‘আমাকে ঢাকায় প্রথম চাকুরি দিয়েছিলেন একজন ফেরেশতা’ কবিতায় কবি মানিক চরম মানবিক, উদার এবং অসম্ভব রকম কৃতজ্ঞপরায়ণতার পরিচয় দিয়েছেন। বলতে দ্বীধা নেই আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, যখন এই সমাজের অমসৃণ উদোর নানা কারণে অকৃতজ্ঞতায় পরিপুর্ণ। কে, কখন, কবে, কি দিয়েছিল, বিপদে, সংকটে, ক্ষুধায়, মন্দায়, মর্মপীড়ায় পাশে দাঁড়িয়েছিল, তা তথাকথিক আধুনিক কিংবা সাধরণেও ক’জনই বা মনে রাখে। কিন্তু মানিক মনে রেখেছেন এবং হৃদয়ে ধারণ করেছেন তার প্রথম রুটি রুজির সন্ধানদাতাকে। শুধু মনেই রাখেননি, তাকে ফেরেশতার সঙ্গে তুলনা করে সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মানবিক সমাজ বিনির্মাণে উপকারির প্রতি কৃতজ্ঞতার ধরন। সেই ফেরেশতার মত মানুষকে হারানোর মর্ম বেদনায় হাহাকার করেছেন মানিক। তাঁর এই বেদনার্ত হৃদয়ের স্পন্দন পাঠককেও স্পর্শ করে সমভাবে মর্মাহত করে। পাঠকের অজান্তেই মানিকের সেই ফেরেশতার জন্য মন থেকে দোয়া এবং আশির্বাদ চলে আসে। মরমী কবি আল মাহমুদ স্মরণে ‘যে শহরে আল মাহমুদ নেই’ কিংবা ‘বৃক্ষের সামনে নুয়ে থাকা এক চারাগাছের আলাপের সৌরভ’ কবিতা দুটি এক অগ্রজ বরেণ্য কবির প্রতি অনুজ আরেক কবির প্রতি অকৃপণ বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ। দুটি কবিতায় কবি আল মাহমুদকে হৃদয়ের গভীরতম স্থানে জায়গা দিয়ে রেখেছেন তাই যেন অন্যরকমভাবে স্মরণ করেছেন মানিক। ‘বিশ্বাসঘাতককে দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করতে নেই’ কবিতায় রুপা এবং রুহী চরিত্র সৃস্টির মাধ্যমে রোমান্টিক কবি হিসেবে অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন। গ্রন্থের প্রায় সব কবিতায় সমকালীন বাস্তবতা, স্পষ্টবাদিতা এবং উপস্থাপনার সারল্য কবি মানিককে সৃজনশীলতার অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তেমনি সৃজনশীলতা এবং ভাষা ও শব্দের ব্যবহারে সাহসিকতার চ‚ড়ান্ত কারিশমা দেখিয়েছেন তিনি।
তাইতো মানিকে অভিভূত দেশবরেণ্য কবি কবি আসাদ চৌধুরী ‘অভিমত’ শিরোনামে গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছেন ‘ফেরেশতার সুগন্ধি রুমালে আমার আত্মা’ নামটি আমাকে ভীষণভাবে স্পর্শ করেছিল, সন্দেহ নেই…টানা স্পন্দিত গদ্য ঢঙে লেখা, কোথাও ধর্মীয় আবেগের আতরের সুবাস, কোথাও অবিচার-সমাচারের প্রতিবাদী প্রায়-ভাষণ-আরবী ফারসি শব্দের ব্যাবহার, যা এখনকার কবিতায় চশমা দিয়েও খুঁজে পাইনা, কবিতাগুলো সাজানো। আমি জানি এই ধরনের কবিতায় পাঠক অভ্যস্ত নন, কিন্তু তিনি পাঠকের মনের কথাটি বলতে পেরেছেন, এতো কম কথা নয়। তবে আমি মুগ্ধ হয়েছি অন্য কারণে। পুঁজিবাদের ভয়াবহতা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাঙ্খা নজরুল থেকে কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য শুধু নয়, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুছ এরা লিখেছেন, ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে এই আবেগ মিশিয়ে আল মাহমুদ বাংলা কবিতার স্মরণীয় শাহজাদা। কিন্তু করপোরেট কালচার এ পর্যন্ত কারো কবিতায় একটি পঙক্তিও পড়েছি, না, কিছুতেই মনে করতে পারছি না, এক্ষেত্রে এই কবি এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বিষয়বস্তু বা বলার ব্যগ্রতা এতই প্রচন্ড যে প্রচলিত ছন্দে না লিখে প্রায় ভাষণের ভঙ্গিটাই তিনি গ্রহণ করেছেন…।’
মুগ্ধ স্বয়ং প্রকাশকও গ্রন্থ প্রকাশের দায়ে বলেই ফেলেছেন ‘এক অনবদ্য সৃষ্টি ‘ফেরেশতার সুগন্ধি রুমালে আমার আত্মা’ শিরোনামীয় সৌন্দর্য ও তার চেতনাবোধ এ কাব্যগ্রন্থকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। বরাবরের মতই এটিও তার আদর্শিক ও স্বকীয় শক্তির নিটোল উপস্থাপনা। শব্দের মায়াজালে আবৃত ভিন্ন স্বাদের ভিন্ন আঙ্গিকে পঙ্ক্তিগুলো কাব্যমোদিদের জন্য এক চরম পাওয়া। কাব্যের রস সঞ্চারে তিনি সর্বদাই সিদ্ধহস্ত। শুধু রসবোধ নয়, কাব্যের অন্তর্নিহিত যে দর্শক তা পাঠক সমাজকে গভীরভবে নাড়া দিতে সক্ষম’। আসাদ চৌধুরী এবং প্রকাশকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলা যায় কবির রচিত প্রায় প্রত্যেকটি পঙ্ক্তিই সুখপাঠ্য, সহজ-সরল ভাষায় বর্ণিত। গতানুগতিক কবিতার মত ‘দুর্বোধ্য’ নয়। ফলে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে কাব্যসত্তায় সুরভিত ‘ফেরেশতার সুগন্ধি রুমালে আমার আত্মা’র মাধ্যমে তার বাণীগুলো আপামর জনসাধারনের দরবারে নির্দ্বিধায় পৌঁছে গেছে। গ্রন্থের শেষে কবি মানিকের অল্প বিস্তর জীবন বৃত্তান্ত পাঠের সুযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে মানিকের নতুন এবং অপেক্ষাকৃত পরিণত এই গ্রন্থটি সাহিত্য অঙ্গনে অনন্য সংযোজন এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এভাবেই চলতে থাকুক কবির স্পর্ধিত কলমের লাঙল। আর উঠে আসুক জাতির জন্য চির কল্যাণকর সুবর্ণ ফসল। কবি মানিকের জন্য শুভ কামনা।
আকাশজমিন/এসএ