নাজনীন নাহার। বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে এই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় একজন লেখক। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে দারুণ জনপ্রিয় সাহিত্যিক তিনি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তাঁর সমান বিচরণ। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অভ‚তপুর্ব সাফল্য অর্জন করেছেন নাজনীন নাহার। এ পর্যন্ত ২০টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। আরো বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। সাহিত্য চর্চা নিয়ে সাম্প্রতিক ব্যস্ততা ও অনান্য বিষয়ে সৃজনশীল লেখক নাজনীন নাহারের সঙ্গে কথা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাজু আহমেদ ।
লেখালেখির শুরুটা কিভাবে হলো?
নাজনীন নাহার : লেখালেখির শুরুটা যথারীতি সেই ছোটবেলা থেকেই। যতদূর মনে পড়ে পড়ার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ থেকেই আমার লেখার শুরু। বেশি ছোটবেলায় লিখতাম বলে মায়ের ভয়ে লেখা লুকিয়ে রাখতাম। পড়তে ভীষণ পছন্দ ছিল আমার। নিজের পাঠ্যবইয়ের ফাঁকে ফাকে বড় ভাই বোনদের পাঠ্যবইয়ের গল্প, কবিতা পড়তাম। তবে তাও লুকিয়ে লুকিয়ে। মা তেমন পছন্দ করতেন না। ‘দস্যু বনহুর’, ‘বিষাদ সিন্ধু’সহ আরও বহু বিদেশী লেখকদের অনুবাদ মাকে পড়তে দেখতাম। আব্বা বাড়ি এলে হ্যারিকেনের আলোয় আব্বা মা মিলে নভেল পড়তেন। তখন তারা উপন্যাস বলতেন না। নভেল বলতেন। তবে মায়ের বইগুলো সব আলমারিতে তালাবন্ধ করে রাখা হতো। কাচের দরজার ফাঁকে তাকিয়ে থাকতাম বইগুলোর দিকে। আর মনে মনে ভাবতাম কবে যে বড়ো হব! এদিকে পাঠ্যবইয়ের পড়া পড়তে পড়তে একসময় খেয়াল করলাম আমি গল্প কবিতার সারমর্ম খুব ভালো বুঝতে পারি। আমার উপলব্ধিগুলো প্রকৃতি ছাপিয়ে মানুষের অনুভবে ডুবে থাকত। সেই থেকেই টুকটাক লেখার শুরু। একসময় আমার বড় ভাই টের পেলেন আমি কিছু লিখি। তার আগ্রহে তখনকার বেশকিছু জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে আমার কিছু লেখা ছাপা হলো। এরপর বিয়ে, পড়াশোনা, সন্তান, সংসার করতে করতে ঠিক সেভাবে আর লেখা হয়নি। তবে পড়েছি প্রচুর। আমার মূল নেশাই ছিল উপন্যাস, কবিতা, কথোপকথন, গল্প পড়া। উপন্যাস আমার চাইই, চাই। খাবার, কাপড় বা আর কিছুর জন্য এমন নেশা ছিল না। যেমন নেশা ছিল উপন্যাসের প্রতি। কখনও কখনও পরীক্ষা শেষ হলে আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে উপন্যাসে ডুবে থাকতাম। এছাড়াও নতুন একটা উপন্যাস জোগার করার পূর্বে আমি আমার কাছে থাকা উপন্যাসের একটা দু’টো করে পাতা পড়তাম। যাতে একেবারে শেষ হয়ে না যায়। মানুষের অনেক রকম নেশা বা আসক্তি থাকে। আমার আসক্তি ছিল পড়া। আমার আসক্তির নাম ছিল উপন্যাস। শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি, বইমেলা জুড়ে বইয়ের নেশা এবং বইয়ের ঘ্রাণে ডুবে থাকতাম একটু সময় পেলেই। আমার কাছে বই মানেই আনন্দ। বই মানেই ছিল প্রেম। বইয়ের প্রতি আমার এতো প্রেমের কারণে আমার হাজবেন্ড আমাকে খুব বই কিনে দিতেন। আবার কখনও কখনও বইকে তার প্রতিপক্ষও মনে করতেন। সে অনেক মজার সব ঘটনা। একটা ঘটনা বলতে চাই, আমার ছেলে যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, আমিও পড়াশোনা করছিলাম তার সাথে সাথে। ছেলে একদিন আমাকে বলল, ‘মা পৃথিবীতে তুমিই একজন মানুষ যে ভালোবেসে লেখাপড়া করো। আর সবাই ঠেকায় পড়ে লেখাপড়া করে। মা তোমার কেন এতো লেখাপড়া করতে ভালো লাগে? সেই লেখাপড়া ভালোলাগাই আমার আবারও লেখা শুরুর কারণ। গত ছয় বছর যাবত আমি একটু একটু করে লিখতে শুরু করেছি ধারাবাহিকতা রেখে। তবে পুরোপুরি নিয়মিত লিখছি বছর চারেক। এখনও খুব পড়ি। আর লেখা আমার কাছে এখন এক মহা নেশার নাম।
লেখক হওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ পেয়েছেন কার কাছ থেকে?
নাজনীন নাহার : ওই যে বললাম আমার পড়া আর সাথে উৎসাহের মূল ভূমিকায় আমি নিজে। ছোটবেলা থেকেই আমি মনে মনে নিজের সাথে প্রচুর কথা বলি। সে আমার দুঃখ দিনে কিংবা আনন্দ দিনে। আর ভীষণ ভালো থাকার জন্য একটা কাল্পনিক জগত সাজানো ছিলো আমার সেই অতি ছোটবেলার অভ্যাস। যেখানে নিজের মতো করে নিজের স্বপ্ন, ভালোলাগা, ভুল, শুদ্ধতার সাথে নিয়ম করে আমি প্রতিদিন ঘুমানোর আগে কিছু সময় কাটাতে পছন্দ করতাম। এভাবেই আমার নিজের ভেতরে একটা বিশাল জগত তৈরি হয়ে গিয়েছিল । যা হয়তো অন্য কোনোদিন কোথাও বলা হবে আমার। এছাড়াও খুব ছোটবেলা থেকেই আমি আমার মতো করে গুছিয়ে এক ধরনের মেডিটেশন করতাম। যার ফলে আমার মধ্যে নিজেকে বোঝার পাশাপাশি মানুষকে বুঝতে পারার সামান্য হলেও কিছু সক্ষমতা তৈরি হতে থাকে। মানুষ হওয়ার একটা বিশুদ্ধ বোধের শিক্ষা আমি যেমন আমার মা বাবা, পাঠ্যবই, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি নিজের আত্মকথন ও আত্ম অনুভব থেকেও। নিজের আচরণ, কথা ও জীবনাচারের একটি পরিশীলিত পরিশীলন আমি খুব অল্প বয়স থেকেই রপ্ত করতে শিখে নিয়েছি। সাথে শিখে নিয়েছিলাম সহন, ক্ষমা এবং পরিশুদ্ধতার পরিশীলন আর এর ব্যবহার কিছুটা। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি। এ সময় অনেককে মোটিভেশনাল কাউন্সিলিং করেছি । মানুষের বিচিত্র জীবন ও জীবনের দহনগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি নানা রঙের জীবন। তাইতো আমি আরও বেশি লেখার তাগিদ অনুভব করেছি। নিজের কিছু দায়িত্ব বোধ আমাকে লেখার উৎসাহ দিয়েছে। যার ফলে শুরু হয়েছে লেখা। শুরু হয়েছে বিশুদ্ধ বোধের এক অষন্ড সন্তরণ ধারণ, যাপন এবং সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস। এসবই আমার অনুপ্রেরণা।
কোন ধরনের লেখায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং কেন?
নাজনীন নাহার : আমি লিখতে শুরু করলে সাহিত্যের প্রায় সব সাবজেক্টেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তবে সবচেয়ে সহজে যা লিখতে পারি তা হলো কবিতা। মুহূর্ত মুহূর্ত কিছু বোধ, অনুভব, শব্দ ও পরিস্থিতি আমাকে কবিতায় ডুবিয়ে কখনওবা ভাসিয়ে নেয়। আমি সময় পেলে অনবরত কবিতা লিখতে পারি, আলহামদুলিল্লাহ। একটার পর একটা, একটার পর একটা। এক বসায় নানান স্বাদের অগুনতি কবিতা আমি লিখে যেতে পারি মুড থাকলে। কবিতায় আমার ভীষণ আনন্দ, খুব স্বাধীনতা। যেভাবে খুশি নির্মাণ করতে পারি। কয়েক লাইনের একটা কবিতায় একটা পরিপূর্ণ জীবনের গল্প বলা হয়ে যায়। আমার কাছে এক একটি কবিতা এক একটি গল্প আর এক একটা উপন্যাসের মতো। কবিতা যেন এক একটি জীবনের সাতকাহন। যা ইচ্ছে করলে চট করে লিখে ফেলা যায়। কিন্তু উপন্যাস লেখায় সরাসরি কিছু জবাবদিহিতা থাকে। থাকে চরিত্রের বিশ্লেষণ। ধারাবাহিকতাও লাগে। ঘটনাক্রম মনে রাখতে হয় বেশ মনোযোগে। লাগে বিস্তৃতি। তবে আমি এক একটি উপন্যাস বা গল্পের চরিত্রে একবার ঢুকে গেলে যেন নিজেই সেই চরিত্র হয়ে উঠি । চোখে কেমন ছায়াছবির মতো স্পষ্ট দেখতে পাই চরিত্রের রং,রূপ এবং গন্ধ। মাঝে মাঝে আমি চরিত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করি। মাঝে মাঝে আমার লেখার গতি ও ঘটনা প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে চরিত্রগুলো। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই গল্প ঘরের প্রতিটি আলো। দৃশ্যমান ঘরের পর্দার কাপড়ের রং। চরিত্রগুলোর পোশাক এবং পোশাকের রং। পথঘাট, নদী, বন যা কিছু লিখি। এমনকি আপনা আপনি আমার মনের চোখ এঁকে ফেলি গল্পের ডান বাম এবং উপন্যাসে উল্লেখিত ঘরের দরজা জানালার দিকগুলোও। আসলে যখন যেই বিষয়ের লেখায় ডুবি ওটাই আমার জন্য স্বাচ্ছন্দ্য। তবুও কবিতা লেখার আনন্দ অনেক বেশি আমার কাছে। শিশুতোষ ছড়া বা লেখাগুলোতোও আমার একটা অন্যরকম আনন্দ পরিতৃপ্তি লাগে। বিশেষ করে আমার ‘সোনামণিদের কলরব’ বইতে যে চব্বিশটি ছড়া আছে তা আমি মাত্র আড়াই ঘন্টা লিখেছি। এভাবেই আমি লেখার নেশায় ডুবে যাই। চিঠি লিখতেও আমার ভীষণ ভালো লাগে। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতা ও কথোপকথনেও আমি যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যখন তখন লিখে ফেলি মনের ভাবনা থেকে অনুকাব্য ও অনুকথা। ভালো লাগে লিখতে ভীষণ লিখতে যে কোনো ধরনের লেখা, আলহামদুলিল্লাহ।
লেখক হিসেবে আপনার পরিবার,সমাজ কিংবা রাষ্ট্র প্রতিবন্ধক নাকি সহায়ক?
নাজনীন নাহার : দু’টোই। আমাদের জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ, রোগ, নিরাময়, সম্পর্ক, আলো, বাতাস, দিন, রাত, পানি বৃষ্টি, বন্ধু, স্বজন, শিক্ষা, অশিক্ষা, খাবার, ক্ষুধা, দারিদ্র, স্বচ্ছলতা, বিত্ত-বৈভব, ক্ষমতা-অক্ষমতা, স্বাধীনতা, পরাধীনতা, মুক্তি, বন্দিতা, প্রেম, অপ্রেম, নৈকট্য, দূরত্ব, মোহ, নির্মোহ এগুলো ও জীবনের পারিপার্শ্বিক সকল কিছু যেমন আমাদের অনুকূলে থাকে আবার এরাই থাকে আমাদের প্রতিক‚লে। ঠিক তেমনি শুধু আমি একা নই। আমাদের সকলের সকল কাজের জন্য পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র একদিকে যেমন সহায়ক। আবার সেখান থেকে কাঙ্খিত বা অনাকাঙ্খিত কিছু প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে যায় গতানুগতিক ধারায়। পরিমাপে কারও জন্য বেশি কারও জন্য কম। এখনে আরও একটি বিষয় থাকে। তা হলো আমাদের দিতে ও নিতে পারার বিষয়টি। পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র আমাদেরকে যেমন দেয়। তেমনি আমাদের থেকে নেয়ও। এই দেয়া নেয়ার ভারসাম্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে যত নিখুঁত ভাবে এর যত চেক এন্ড ব্যালেন্স করতে পারবে, সে টিকে থাকবে এবং সে জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সফল হবে। জীবন মানে যেমন পরিপূর্ণ এক আনন্দের নাম। তেমনি জীবন মানে এক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের নাম। আর আমাদের সম্পর্কগুলো বেশির ভাগ সময় জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার মুক্ত করে। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রই আমাদের সকলের জন্য স্বীকৃত সহায়ক। মানুষ তার প্রজ্ঞা, কর্ম, দূরদর্শিতা, আচরণ এবং পর্যবেক্ষণ দ্বারা জীবনকে যত সুচারু রূপে পরিচালনা করবে। মানুষ তার প্রতিটি কর্ম, সৃষ্টি, প্রত্যাশা, সময়ের দাবি এবং বঞ্চিত করার মধ্যে সামঞ্জস্য যত নিখুঁতভাবে করবে ততই মানুষের জন্য সবকিছু সহজ, সহন ও প্রতিবন্ধকহীন মনে হবে। তার মানে কি দাঁড়াল! সবকিছুই আমাদের অনুকূলে আবার সবকিছুই আমাদের প্রতিকূলে। প্রয়োজনে আমি বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হব আশা করছি। একটা উদাহরণ দেই আজ। যেমন ধরুন একটা স্বাধীন স্বার্বভৌম গনতান্ত্রিক দেশে আপনি আমি সরাসরি সরকারের কোনো অন্যায় বা ভুল কাজের বিরুদ্ধে লিখতে পারব। এটা গনতান্ত্রিক অধিকার। যা আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত আইন বাক স্বাধীনতার। কিন্তু আমি এমন কিছু লিখলেই আমাকে সরাসরি দেশদ্রোহীতার আইনে ফাঁসিয়েও দেয়া হতে পারে। এটা দেশের সার্বভৌমত্বের অধিকার হয়ে যাবে। এবং এটাই সঠিক। তার মানে কখনও কখনও দু’টোই সঠিক। একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দু’টোরই ব্যবস্থা হয়। তার মানে আমাকে কি করতে হবে! আগে আমার টিকে থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। তখন পরিশীলিতভাবে আমি আমার লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারব। সরকার তো আমাদের ঠিক প্রিয় পরিবারের মতো। গণতন্ত্র তো জনগণের। আমি তো সেই জনগণ। আমার জন্য প্রায় সব যেমন অনুকূলে। এমন করেই পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র আমার জন্য। আমার মা একটা বচন বলতেন, ‘বললে মা পিটানি খাবে, না বললে বাবা হারাম খাবে’।
ব্যক্তি জীবনের সংকট, প্রাপ্তি, ব্যর্থতা, সফলতা, ভালোবাসা, প্রেম এসব কি লেখায় প্রভাবিত হয়েছে?
নাজনীন নাহার : অবশ্যই। আমি নাজনীন নাহার আমার ব্যক্তি জীবনের উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা, দেখা, বোধে বাঁধা বিষয়, ঘটনা, সমাজ, সংসার এবং সম্পর্কের নানাবিধ টানাপোড়েন, পথে ঘাটে চলতে ফিরতে কিছু চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। আমার আশেপাশের, পরিবার পরিজনদের জীবন, আচরণ, ভাষা, ব্যাবহার। আমার ও আমার কাছের মানুষদের শারীরিক ও মনস্তাত্তি¡ক চিন্তাধারা ও কর্ম পরিচালনা আমার লেখার উপজীব্য। সাথে দৃষ্টিভঙ্গি, দূরদৃষ্টি, পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন আমার লেখার মূল। সাথে আছে অসীম এক কল্পনা শক্তির উপাসনা ও প্রয়োগ। মেডিটেশনের এক নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন মানুষকে খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং অনুধাবনের প্রচেষ্টা। এই সবকিছুর সম্মিলনই আমার লেখার প্রতিপাদ্য।আমি জীবন নিয়ে লিখি। জীবনের প্রায় সকল দিক নিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। আমি আমাকে লিখি, লিখি আপনাকেও। সকলকে এবং সকলের জন্য লিখতে চেষ্টা করছি।
একজন লেখক হিসেবে পরিবার থেকে কতটা সাপোর্ট পান?
নাজনীন নাহার : আসলে আমার কাছে আমার পরিবারই হলো প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেখানে সহজতা, আরাম ও শান্তিটা একটা অনিবার্য সত্য। তাই লেখালেখিসহ সকল ক্ষেত্রেই পরিবারের সহযোগিতা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পরিবারের শতভাগ সহযোগিতা যেমন আমার সৃষ্টির পথ ও পরিসরকে সহজতর করে সমৃদ্ধ করতে বড়ো ভূমিকা রাখে। ঠিক তেমনি পরিবারের কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতা আমি এবং আমাদের প্রায় সকলের সৃজনশীল কাজকে আরও দঢ়ভাবে পরিচালনা করতে শক্তি যোগায়। আমার জন্য দু’টোই সমান্তরালে চলে। সহযোগিতা শতভাগ আবার প্রতিবন্ধকতাও শতভাগ। তবে আমার প্রতিবন্ধকতাগুলোকে আমি সুনিপুণ ভাবে শক্তিতে ও বিশ্বাসে পরিনত করতে পারি। তাই আমি আমার পরিবারকে শতভাগ সহযোগি হিসেবেই দেখি। একটা উদাহরণ দেই। আমার হাতের রান্না ছাড়া আমার পরিবারের মুখে অন্য রান্না রোচে না। এছাড়াও এরা খুবই ভোজনরসিক। এমনকি আমার একুশ বছরের ছেলেকে কাছে থাকলে এখনও আমার ভাত মেখে দিতে হয়। সাথে ছেলের বাবাকেও অনেক সময় ভাত মাখিয়ে দিতে হয়। এটা একদিকে যেমন আনন্দের তেমনি কখনও কখনও লেখালেখির ক্ষেত্রে কিছুটা প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করে। যেমন লিখতে গিয়ে আমি হয়তো একটা কবিতার মাঝামাঝি ডুবে আছি কিংবা উপন্যাসের কোনো চরিত্র চিত্রায়নে একটা কঠিন প্লট লিখছি। এমন সময় কোনো বিশেষ রান্নার আবদার কিংবা খাবার মাখিয়ে দেয়ার বায়না। কিংবা হুট হাট মেহমান নিয়ে চলে আসা। এ সব পরিস্থিতি লেখার মুড এলোমেলো করে দেয়। ঠিক তেমনি এই প্রতিবন্ধকতাগুলোকে শক্তিতে পরিণত করে আমি আমার বোধের জায়গাটাকে আরও বেশি শক্তিশালী করে নেই। যাতে আমি লেখার বিরতির পরেও খুব দ্রæত আবার লেখাটার পূর্বের অবস্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে পারি। এটা নিয়মিত অনুশীলনের ফলে আমার আয়ত্ত করা সম্ভব হয়েছে। হয়তো পরিবারের এমন আবদারগুলো না থাকলে আমি যে কোনো কারণে কোনো লেখা থেকে হঠাৎ উঠে যেতে হলে, আর হয়তো এতো সহজে সেখানে ব্যাক করতে পারতাম না। পরিবার যেমন আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দের জায়গা। ঠিক তেমনি লেখালেখিও আমার এক সুবিশাল আনন্দ অনুভব।
সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে কি ধরনের সমাজ নির্মাণ করতে চান? নিজের প্রতি আপনার প্রত্যাশাই বা কি?
নাজনীন নাহার : আমি চাই সমাজ তথা গোটা পৃথিবীর মানুষের মননে সত্যিকারের মনুষ্যত্ব বোধের জাগরণ ঘটুক। মানুষের মন ও মগজে বিশুদ্ধ বোধের অখনড সন্তরণ চালনা করতে চাই। চাই মানুষ প্রকৃতভাবেই মানুষ হোক। আমরা কেবল নামে নই। আমাদের চিন্তা, বোধ, কর্ম, আচরণে যেন মানবিক হই। মানুষ হই। ভবিষ্যত জানি না। তবে বর্তমান সময় অবধি অধিকাংশ মানুষের ন্যূনতম খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা আছে । নেই কেবল ধৈর্য, সহ্য, ক্ষমা, মায়া, মানবতা, সঠিক বন্টনের মানসিকতা, সু-স্বাধীনতা। মানুষের মনন ও চিন্তায় শেকড় গেঁড়ে রয়েছে লোভ, হিংসা, ক্ষমতার অপব্যবহার, কামের দাসত্ব, সীমাহীন ক্ষুধা, আমিত্বের প্রহসন, আলস্য, সর্টকাট সফলতার নেশা। আমি চাই এর থেকে মুক্তি। ধর্মগ্রন্থও তাই চেয়েছে, নবী রাসুলগণ তাই চেয়েছেন, মুনি ঋষিগণও তাই চেয়েছেন। এ চাওয়া নতুন নয়। পুরাতন। আমি এই পুরাতন চাওয়াকেই নতুন করে চাই। নিজে এর জন্য উদাহরণ হয়ে তৈরি হতে চাই সর্বাগ্রে। শুরুতেই শত সহগ্র না হোক। গুটিকয়েক জন হোক। শুরু হোক। আমাদের অধিকাংশ বাবা-মায়ের মধ্যে আদর্শের বালাই নেই। অথচ আমরা চাই সন্তান হোক আদর্শবান। শিক্ষকদের মধ্যে নৈতিকতা নেই, অথচ ভবিষ্যত প্রজন্মকে হতে বলি নীতিবান। সরকার থেকে শুরু করে কোথাও কোনো স্বচ্ছতা নেই, অথচ চাই জাতি হোক স্বচ্ছ। এভাবে হবে না। যে যেখানে বিশুদ্ধ বোেেধর অখনড সন্তরণে বিশ্বাস করবেন। তিনি বা তা তার চিন্তা, কর্ম ও ব্যাবহারে ধারণ করুন এবং যাপন করুন। আসুন নিজে ক্ষমাশীল হই। চলুন আমরা সহনশীল হই। হই মানবিক। হই মানুষ। মায়া ছড়াই আমাদের আশেপাশে আমাদের সম্পর্কে এবং সাহচর্যে। আসুন নিজের চেয়ে সকলকে একটু হলেও বড়োা মনে করি। নিজেকে যত বেশি ক্ষুদ্র মনে করব, সকলকে ততই বৃহৎ দেখতে পাব। আসুন নিজ নিজ জায়গা থেকে সকলকে সহযোগিতার হাত বাড়াই। যার যতটুকু সাধ্য তার মত করেই। অন্তত একটু ভালোভাবে কথা বলি সকলের সাথে। হাসিমুখে পথ চলি। কটুকথা না বলি। এগুলো করতে তো আর টাকা বা তেমন পরিশ্রম লাগে না। আসুন আমরা প্রত্যেকে আমাদের ঘর থেকে শুরু করি। শুরু করি কাছের জন থেকে। আর এই বোধ, চিন্তা, বিশ্বাসের কার্যকর প্রতিষ্ঠার বিপ্লবই আমার লেখার মূল ব্রত। যা আমি চাই আমার মৃত্যুর পরেও বলবৎ থাকুক। থাকুক চলমান। আমার লেখা হোক মানবতার সেøাগান। মনুষ্যত্বের সহবস্থান। আমরা নিজের জন্য যা চাইব তা অপরের জন্যও যেন চাইতে পারার মানসিকতা গঠন করতে পারি কিছুটা হলেও।
আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান ও অধিকার নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
নাজনীন নাহার : এক কথায় বলতে গেলে আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী কেউ প্রকাশ্যে কেউ সংগোপনে এখনও অবহেলিত, শোষিত, নির্যাতিত হয়। শারীরিক আর নিশ্চিত বিবিধ রঙের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির আসলেই সেভাবে বদল হয়নি। বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনেক বদল স্পষ্ট। কিন্তু ভেতরে ভেতরে! ভেতরে ভেতরে এক একজন নারীকে কি কি এবং কীভাবে সহন করতে হয়, ম্যানেজ করতে হয়, ভুগতে হয় তা নারী মাত্রই জানেন। এখনও নারীর দহন প্রকাশের গলায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মান ইজ্জত ও সম্মান নামক শক্তিশালী দন্ডাদেশ। যা শক্ত শেকড় বহু বহু পূর্ব সময়ের গহীনে প্রথিত। এতে ফায়দাটা পুরোপুরি পুরুষদের। তাই সহজ নয় এর শেকড় উপড়ানো। কেবল যুদ্ধ করো, টিকে থাকো আর ভোগো। কারণ তুমি নারী। বিয়ে নারী জীবনের একমাত্র মূলমন্ত্র এখনও। যতই সফল হোক একজন নারী। একটি বিয়ে না হলে, বা না করলে সমাজে তাকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। একজন পুরুষ অবিবাহিত থাকলে একটা মায়া বা অভিমানের দৃষ্টিতে দেখে সমাজ। নারীর নিরাপত্তার মানদন্ড এখনও পুরুষ। নারী এখনো পুরুষের ভোগ ও সেবাদাসী। একটু মনোযোগ দিলেই দেখতে পাবেন যে নারীর নিরাপত্তা বলতে এখনও এক বা একাধিক পুরুষ। আবার নারীর অনিরাপদ জীবনের কারণও এক বা একাধিক পুরুষ! কী আশ্চর্য ভয়ঙ্কর এক নির্লজ্জ সত্য এটা। আমি একাধিক উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারব। বুঝিয়ে দিতে পারব কীভাবে ধর্মের বিভিন্ন মারপ্যাচের বলি বা শিকার এখনও নারী। চরিত্র শব্দের ব্যাবহার বা অপব্যাবহারেও নারীর নামটাই উপজীব্য এবং সহজতর উচ্চারণ। নারীর কাছেও নারী নিরাপদ নয়। কেন জানেন! কারণ বহু বহু শত কোটি বছরের নারী জন্মের নিপীড়ন ও হীনমন্যতাই এর জন্য দায়ী। খুব সহজ হিসেব। দুর্বলকে ঘায়েল করা সহজ। আর দুর্বল বলতে নারীকেই বুঝি সবাই। তাই কোনো অফিসার নারী ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যাবহারটা তার অধিনস্ত নারী সহকর্মীর উপরই প্রাকটিস করে। কারণ তার ঊর্ধ্বতন পুরুষ কর্মকর্তার নানাবিধ চাপে বিপর্যস্ত নারী অফিসারটি তার অধিনস্ত একজন নারী সহকর্মীকে নরম পেয়ে চাপে রাখে। একজন নারী মা তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিজের ছেলের বউদের উপরেই প্রয়োগ করে। মেয়ের জামাইয়ের উপরে নয়। নিজের শাশুরির অত্যাচারের প্রতিশোধ বেশির ভাগ সময় ছেলের বউদের উপরে নেয়। দেখুন চোখ খুলে, এখনও আমার ঘরের ছেলেটা দশ রাত বাইরে কাটিয়ে আসলে ছেলে বা পরিবারের ইজ্জত মান যায় না। কিন্তু আমার ঘরের মেয়েটি এক রাত বাইরে কাটালে তার ইজ্জত যায় যায় অবস্থা। মানুষ মগজের দৈনতা নারীদেরকে সহজ হিসেবে তুচ্ছ করে রেখেছে। শারীরিক শক্তিতে ও গঠনগত দুর্বলতাও নারীকে অনেকাংশে হীনমন্যতায় রেখেছে। একটা মেয়েকে যখন তখন এক বা একাধিক পুরুষ যেখানে সেখানে চেপে ধরে যৌন নির্যাতন করে। এক বা একাধিক মেয়ে কিন্তু তা করে না। এই যে মগজ ও মননের দৈনতা ও ভয়, তা আমাদের নারীদেরকে বহু পিছিয়ে রেখেছে। দু’চারজন হয়তো বেড়িয়ে এসেছে। কিন্তু কোটি কোটি নারীর মিছিলে দু’চারজন সংখ্যা সংবাদে স্থান পায় না। এসব থেকে পরিবর্তন আনতে হলে কঠোর আইন শুধু প্রণয়ন করলেই হবে না। এর সঠিক প্রয়োগ আবশ্যক। আবশ্যক বাস্তবায়ন। আর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষদের ব্যক্তি মননের শিক্ষা। যা ঘর থেকে, পরিবার, থেকে, পরিজন থেকে, বন্ধু, শিক্ষক, প্রতিবেশী এবং সর্বোপরি সকলের কাছ থেকে নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে। প্রত্যেক মা তাঁর নিজের ছেলে মেয়েকে শেখাবেন। ভাই শেখাবে বোন ও ভাইকে। শিক্ষক শেখাবে। মসজিদ, মন্দির গীর্জাসহ সকল উপাসনালয় শেখাবে। ওই যে ফিরে ঘুরে সেই বিশুদ্ধ বোধের অষন্ড সন্তরণের চালনা করা। মন ও মগজের কোষে কোষে। নারী পুরুষ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, নয় প্রতিহিংসা। সহযোগিতা করতে হবে একে অপরকে। নারী পুরুষের সমানাধিকার নয়, নারী পুরুষ উভয়কে উদযাপন করতে হবে মানুষ জীবনের সমান অধিকার। নারী অধিকার ও পুরুষ অধিকার শব্দ দু’টি অভিধান থেকে তুলে দিতে হবে। সকলে এক নামে বাঁচবে। তা হলো মানুষ নামে, মানুষ বোধে, মানুষ সম্মানে। এটা যতদিন না হবে ততদিনই নারী স্বাধীনতা ও পরিপূর্ণ নারী সম্মানের নামে চলবে শুভঙ্করের ফাঁকি। যা নারীকে উত্তর থেকে উত্তর আধুনিক যুগেও একই প্রহসনে আবদ্ধ রাখবে। সকলকে বুঝতে এবং প্রয়োগ, পরিচর্যা করতে হবে যে, জীবন শুধু নেয়ার জন্য নয়, নয় কেবল ভোগের জন্য। জীবন একে অপরকে দেয়ার জন্যও। প্রতিজন বাবা হবেন সত্যিকারের খাঁটি বাবা। ভাই একজন পরিপূর্ণ ভাই হবে। বন্ধুটা ঠিকঠাক বন্ধুর আদর্শে উজ্জীবীত হবে। প্রতিবেশি শুধু পুরুষ হয়ে গড়ে উঠবে না। সে হবে মানুষ গঠনে মানুষ। মননে চিন্তায়, দায়িত্বে, ব্যাবহারে সকলকে জন্মের পর থেকেই এক মানুষ বোধে গড়ে তুলতে হবে। ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ এবং এর সবল দুর্বল দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়।মানুষ হিসেবে জীবন এবং বেঁচে থাকাকে পারস্পরিক আনন্দের আয়োজনে সাজাতে হবে। স্বামী স্ত্রী পারস্পরিক শান্তি বিলানোকে নিজের শান্তি মনে করবে। প্রত্যেক পুরুষকে মানুষ গঠনে বড়ো করতে হবে। হায়েনা গঠনে নয়, অধিপতি গঠনে নয়, নিরাপত্তার কারিগর গঠনে নয়। গঠন হতে হবে সহযাত্রী এবং সহযোগী হিসেবে। একবারও কেউ ভেবে দেখেছেন পুরুষকে কেন নারীর নিরাপত্তার দায়িত্বশীল মনে করা হয়? পুরুষ কার কাছ থেকে নারীকে নিরাপদ রাখে? আর্থিক নিরাপত্তা? না। কারণ প্রতিটি নারীই চেষ্টা করলে উপার্জনে সক্ষম। হায়েনা, বাঘ, কুমির, শেয়াল, কুকুর , প্রাকৃতিক দুর্যোগ! এগুলো থেকে কি পুরুষ নারীকে নিরাপদ রাখে? যা নারী পারে না। তা নয় কারণ হায়েনা, বাঘ, কুমির, শেয়াল কুকুর এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরকেও একই ভাবে আক্রমণ করবে। তাহলে নারী কেন এতো অনিরাপদ? কোন সে বীভৎস, ভয়ঙ্কর পিশাচ! যারা যখন তখন নারীর জীবনকে অনিরাপদ করে তোলে ? মনে করুন, খুঁজুন। পেলেন! আপনার আমার নিকটেই তারা থাকে। তারা পুরুষ। তারা কামুক, তারা ধর্ষক, তারা বিকৃত যৌনাচারী,তারাই হায়েনা, তারাই নরপিশাচ। এতোক্ষণে কি বুঝলেন! ও আচ্ছা এগুলো আপনি নন। ঠিক আছে মেনে নিলাম আপনি নন। কিন্তু এটা তো মানতেই হবে আপনাকে আমাকে সকলকে যে, এরা সকলেই পুরুষ। ভাবুন। গভীর ভাবে ভাবুন। মাগো আপনার পেটের পুত্র সন্তানকে মানুষ জন্মে চান পুরুষ জন্মে নয়। শুরুটা করি চলুন। দেখবেন একদিন সকল মানুষ মানুষের জন্য নিরাপদ হবে ইনশাআল্লাহ। এসব কিন্তু খুব কঠিন কিছু নয়। চেষ্টা করলে মনে ধরলে সহজ। একটা সময় শেষে তো ঠিক মৃত্যুর কাছেই যেতে হবে। তাই এই জন্ম থেকে মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়টাতে আরও চাই আরও চাই এবং যেভাবে খুশি সেভাবে খাই এই উপলব্ধিটা বদলিয়ে নিয়ে। নিজে কি দিতে পারছি, নিজে কতটুকু মানুষ হচ্ছি এটার হিসেব করতে শুরু করি। আসলে এই দেয়ার চেষ্টার ব্রত নিতে হবে নারী পুরুষ সকলকে। সত্যিকারের মানুষ জীবন যাপনই মানুষ তথা নারীকে মানুষ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারবে। নারী পুরুষ সমান অধিকার নয়। মানুষ জন্মে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই মানব জীবন স্বার্থক।
একজন নারী লেখক হিসেবে সুবিধা এবং অসুবিধা কি?
নাজনীন নাহার : নারী লেখক হিসেবে সুবিধা তেমন বাড়তি কিছুই নেই। তবে অসুবিধা আছে যথেষ্ট। আর যতটুকুওবা সুবিধা পাওয়া যায় তা নারী হিসেবে নয়। তা কেবল মানুষ হিসেবে। তা কেবল সৃষ্টির সমৃদ্ধির হিসেবে। অবশ্য নারী হিসেবে লেখালেখির প্রসারে এই স্বল্প সময়েই আমার কাছে কিছু প্রস্তাব এসেছিল এবং এখনও আসে।এগুলো আসলে কিছু পুরুষদের থেকে নয় আসে কামুক পুরুষদের কাছ থেকে। আমার গডফাদার হতে চায় সেই কতিপয় পুরুষগণ। আমার সৃষ্টির ও সৃষ্টির সাফল্যের দায়িত্ব নিতে চায় কতিপয় ভোগী পুরুষ। তারা দয়াপরবশ হয়ে দায়িত্ব নেবে। আরে বাহ! আপনি এবং অনেকেই ভাবছেন ইস্ নারী লেখক হওয়ার কী ভীষণ সুবিধা। মনের সুখে লিখবেন। আর তার প্রচারের, প্রতিষ্ঠার, সাফল্যের দায়িত্ব কেউ এসে নিয়ে নেবে। কি আনন্দ আকাশে বাতাসে, আরে না ভাই! এতো নাচবেন না কেউ। কারণ আমাকে তিনি বা তারা আমার লেখার জন্য কোনো মূল্যায়ন করতে আসেননি। তিনি বা তারা এসেছেন আমাকে বন্ধু, প্রেমিকা, ওয়েল উইশার বা গডফাদার নামে তার নিয়মিত একজন রক্ষিতা করে রাখতে। সাফল্য কোথায় তা তাদের ফাঁদে পা দেয়া এবং ভুক্তভোগী নারীরা জানেন। একজন সত্যিকারের নারীর জন্য এটা অবশ্যই সম্মানের নয়। এটা অসম্মান। কারণ এমন প্রস্তাব কোনো পুরুষকে শুনতে হয় না। কেউ যদি এগিয়ে এসে বলতে চান। কোনো নারী প্রভাবশালী জনৈক পুরুষ লেখককে এমন প্রস্তাব দিয়েছেন। তাহলে আমি বলব। যুগের তাহলে পরিবর্তন হয়েছে কিছু। আজীবন দাঁতের কামড়ে থেঁতলে যাওয়া জিহŸা এ কোন ঐশ্বরিক শক্তিতে আজ দাঁতকে এমন মরণ কামড় বসিয়ে দিলো হে! তবে এসব এবং আরও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা একজন নারী বা একজন মানুষ কেবলমাত্র তার সৃষ্টির উৎকর্ষতা দিয়ে প্রতিহত করতে পারে। পারে কিছু দূরদৃষ্টির প্রয়োগের মাধ্যমে। সিঁড়ি দেখলেই লাফ দিয়ে উপরে ওঠার জন্য কেউ দৌড় লাগাবেন না প্লিজ। উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোর প্রতিটি ধাপে যথেষ্ট সময় ও খেয়ালে পা ফেলে নিজের ভারসাম্য বজায় রেখে উঠতে হবে। তাড়াহুড়ায় যে সুউচ্চ সাফল্য তাকে মিরাকল বলে। প্রকৃত অর্জন ভিন্ন জিনিস। আমি তো নারী পুরুষ সকলকে উদ্দেশ্য করেই বলি, চলুন বিশুদ্ধ বোধে বাঁচি। চলুন নিমগ্ন হই সৃষ্টির আদিতে। চলুন নির্মাণ করি সুচিন্তিত এবং সর্বাত্মক সু-সৃষ্টি। আপনি বা তুমি কে? আপনি কতটুকু! তা কোনো বিষয় নয়। আপনার সৃষ্টিই সত্যিকারের শক্তি হোক। আপনি ব্যক্তিটা শুধু নন। অবশ্যই পৃথিবীতে টিকে থাকবে এবং কথা বলবে আপনার সৃষ্টি। আমি বিশ্বাস করি আমার মুখ দেখে নয়। নয় নারী বলে। আমার সৃষ্টিকে মানুষ অবশ্যই চিনবে। মানুষ অবশ্যই খুঁজবে আমার নামটা। কথা বলবে আমার সৃষ্টি আমার মুখচ্ছবি নয়। অবশ্য এটা আমার একান্ত নিজস্ব অনুভব। কথা হচ্ছিল নারী লেখক হিসেবে সুবিধা এবং অসুবিধার আসলে সুবিধা অসুবিধা সবার জন্য এবং সবকিছুতেই থাকবে। তা অতিক্রম করার ধৈর্য ও প্রজ্ঞার প্রয়োগ করে একজন মানুষকে টিকে থাকতে হবে একজন সৃজনশীল মানুষ রূপে। গ্রহণযোগ্য করার মতো সৃজনের সন্ধান করতে হবে। নির্মাণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুবিধা তৈরি করে নেবে সৃষ্টি। নারী কিংবা পুরুষ সত্তা নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি মূলধারার চর্চার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে কি না?
নাজনীন নাহার : মূলধারা আসলে কি! মূলধারাটাই তো আসলে জীবন। মূলধারাটাই সময়ের স্বীকৃতি আর মানুষের গ্রহনযোগ্যতা। জীবন ও মানুষকেই তো উপস্থাপন করে মূলধারা। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক কি করে! এই মাধ্যমগুলোও তো মানুষ আর মানুষের জীবনকেই উপস্থাপন করে। তাহলে তারা কেন একে অপরের প্রতিবন্ধক হবে! অবশ্যই একে অপরের সহযোগী ও পরিপূরক হবে। সময়ের সাহিত্য ও সংষ্কৃতিই সঠিক এবং মূলধারার সংষ্কৃতি। গ্রহণযোগ্য সাহিত্য ও সংষ্কৃতিই মূলধারার সংষ্কৃতি। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, অনলাইন মাধ্যমই বর্তমান সময়ের গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকর সংষ্কৃতি এবং এই সময়ের সংষ্কৃতি। একে বাদ দিয়ে যেমন বর্তমান জীবন ও সভ্যতা অচল হবে। তেমনি মূলধারার সাথে সম্পৃক্ততাও বিঘ্নিত হবে। তাই আমার মতে এরা একে অপরের প্রতিবন্ধক হতেই পারে না। হতে হবে একে অপরের পরিপূরক। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যেহেতু মূলধারাটা কি? তাই এর গতানুগতিক উত্তরটাই বলছি। যা সনাতন তাই মূলধারা। একবার ভাবুন তো বর্তমান সময়ের মূলধারাটাও একসময় মূলধারার বাইরে ছিল। অতীত থেকে বর্তমান আমরা কি দেখেছি। দেখেছি প্রগতিশীলতাকে বর্জন করার প্রবণতা। যদি বলেন প্রিন্ট মিডিয়া মূলধারা আর অনলাইন মিডিয়া মূলধারার বাইরে এবং ভুল বা মূল্যহীন। তাহলে আজকাল আমরা কেন প্রিন্ট মিডিয়াকে হাতের নাগালে নিয়ে এসে সহজে জানার বোঝার এবং সৃষ্টি প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছি সকলে। অনলাইন মিডিয়াই নিয়মিত প্রিন্ট মিডিয়ার কাজগুলোকে আরও সহজতর করে দিচ্ছে। অনলাইনে প্রচার এবং প্রসারের মাধ্যমে প্রিন্ট মিডিয়ায় যায়গা করে নিচ্ছে অনলাইন সাহিত্য। এটা তো মন্দ কিছু না। এটা সময়ের দাবী। একসময় রবীন্দ্রসংগীতকে মূলধারার বাইরের বলা হতো। অথচ সময় এবং মানুষের গ্রহণযোগ্যতা সেই রবীন্দ্রসংগীতকে আজ মূলধারায় অন্তর্ভূক্ত করেছে যথেষ্ট দৃঢ়তায়। আবার রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে যখন শরৎচন্দ্র দেবদাস নিয়ে এলেন। তখন তথাকথিত মূলধারার বিজ্ঞজনেরা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসকে রগরগে এবং মূলধারার বাইরের বলে ঘোষণা করে দিলেন এবং পাঠকদেরকে তা বর্জনে উৎসাহিত করতে লাগলেন। মূলধারার পরিচয় বহনকারী গুণীজনেরা পাঠক, গ্রোতা এবং মানুষকে যতটা বোকা মনে করেন ততটা বোকা তারা নয়। এক শ্রেণীর পাঠকরা যথেষ্ট সচেতন। তাই সময়ের সমৃদ্ধ সৃষ্টি সময়ের পরিক্রমায় নিজেকেই নিজে মুলধারার ধারক ও বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নেয়। এটা ইতিহাসের সাক্ষী। সাহিত্য, চলচ্চিত্র, সংগীত, খেলাধুলা, সাংবাদিকতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনাচার।এই সকল ক্ষেত্রেই মূলধারা সহজে গ্রগতিশীল চিন্তাধারা ও জীবনাচারকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। মূলধারার দাবীদাররা বেশির ভাগ সময় কথা বলে প্রগতির বিরুদ্ধে, অগ্রগতির বিরুদ্ধে। মনে রাখতে হবে আজকের প্রগতিই আগামীর মূলধারা। যেটা গণমানুষের এবং যেটা আধুনিক তাই গ্রহণীয়। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আজ মূলধারার দিকে ধাবিত এক শক্তিশালী সত্য। আজকের প্রযুক্তি, আজকের প্রগতি এবং আজকের আধুনিকতা কি দিচ্ছে! দিচ্ছে সহজে প্রচার, প্রসার, সময়ের অপচয় রোধ, সহজে সংগ্রহ সর্বোপরি সকল দিকের সমৃদ্ধি। সবদিক থেেেকই তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এবং ব্যাবহার সাহিত্য সহ সকল পরিসরকে গতিময় করছে। ভুল ত্রæটি পূর্বেও কম বেশি ছিল। এখনও কম বেশি আছে। তাই অনলাইন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মূলধারার সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে না। বরং মূলধারাকে আরও স্বয়ংসম্পুর্ণ করবে। একদিন মূলধারাকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ ও সমৃদ্ধ করবে এই অনলাইন প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সময়ের বদল হচ্ছে তাই বদল হতে হবে চিন্তা ও মননের। সময়ের সর্বোচ্চ ব্যাবহার করে আমাদের সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সহজকে সহজ করে গ্রহণ করার মধ্যেই সার্বিক কল্যান ও সাফল্য। তাই পুরাতনের সাথে নতুনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয় সহযোগিতা ও সহবস্থানই সৃজনশীলতাকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।
নান্দনিক বা সৃজনশীল সাহিত্য বলতে আদৌ কি কিছু আছে? থাকলে সমাজে তার কিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়?
নাজনীন নাহার : অবশ্যই আছে। মূলত সাহিত্য মানেই তো জীবনের ও বোধের নান্দনিকতা। সাহিত্য মানেই আচরণের নান্দনিকতা। সাহিত্য মানেই চিন্তা ও বোধের নান্দনিকতা। মানুষের জীবন বোধ, অনুভূতি, উপলব্ধি এবং আচরণের সুনিপুণ পরিশীলনই সাহিত্যের নান্দনিকতা। যার নান্দনিকতায় আমরা আমাদেরকে এবং আমাদের জীবনকে আরও উন্নত বোধের পর্যায়ে নিয়ে যাই। একজন ভিক্ষুক কিংবা একজন গণিকার জীবন। একটি পিঁপড়া কিংবা প্রজাপতির জীবন। একজন সুস্থ মানুষ কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন। এদের সকলের আচরণ, অভিব্যক্তি, অভ্যাস, বাচন সহ প্রতিটি ক্ষেত্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উপস্থাপন করা, তুলে ধরাকেই সৃজনশীল সাহিত্যের অংশ বলে। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতিটি গতিবিধি, প্রকাশ ও পরিবর্তন যে সাহিত্যে সুনিপুণ ভাবে উপস্থাপন করা হয়। তাই সাহিত্যের সৃজনশীলতা। যে সাহিত্য আনন্দ রসে পরিপূর্ণ, যে সাহিত্য আমাদের মন ও চৈতন্যকে নন্দিত করে। যে সাহিত্য আমার পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তিময় মনের খোরাক। তাকেই নান্দনিক বা সৃজনশীল সাহিত্য বলে। সৃজনশীল বা নান্দনিক সাহিত্যের কদর সর্বকালে সর্বমনে স্বীকৃত। সমাজকে সুষ্ঠ, স্বাভাবিক এবং সার্বজনীন পরিশীলন করে সৃজনশীল সাহিত্য। সৃজনশীল সাহিত্য মানুষকে মনুষ্যত্ব বোধে উজ্জীবিত করে। মানবিক জীবন বোধে সমৃদ্ধ করে। পারস্পরিক সম্মান এবং সহনশীলতার চর্চা করায়। মানুষের রুচিবোধ ও সুগঠিত সুন্দর জীবন বোধের শিক্ষা দেয়। সামাজিক আচরণের সুচারু পরিশীলন করে সৃজনশীল সাহিত্য। সমাজ বদলে এবং সমাজকে সুসভ্য করতে, মানুষকে সুসভ্য জাতিতে পরিণত করতে সৃজনশীল সাহিত্যের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সুশীল সমাজ গঠনে সৃজনশীল সাহিত্যের কোনো বিকল্প নেই। তাই সমাজে সৃজনশীল সাহিত্যের প্রতিক্রিয়া অবশ্যই ব্যক্তি, পরিবার, সনাজ ও রাষ্ট্র তথা মানুষের জন্য ইতিবাচক।
আপনার প্রিয় লেখক-লেখিকা কে ? কোন কোন গ্রন্থ আপনাকে অনুপ্রাণীত করে ? কোনটি বার বার পড়েন?
নাজনীন নাহার : অনেক অনেক লেখক আমার প্রিয়। সবচেয়ে বেশি পড়েছি বুদ্ধদেব গুহর লেখা উপন্যাস। ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘মাধুকরী’, ‘সবিনয় নিবেদন’, ‘ঋভু’ এমন অগুনতি উপন্যাসের আমি ভীষণ ভক্ত। মন কেমনের বায়নারা কখনও কখনও এলোমেলো হতে থাকলে আমি বারংবার ‘মাধুকরী’ খুলে বসাতাম। ‘সাতকাহন’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘অনিল বাগচির একদিন’ সহ কত কত অগুনতি উপন্যাস আমার প্রিয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর, শীর্ষেন্দু, মৈত্রীয় দেবী থেকে শুরু করে অরুন্ধতী রায়, কাফকা, আরজ আলী মাতুব্বর, সমরেশ, হুমায়ুন আহমেদ, মহাদেব সাহা, পূর্ণেন্দু পত্রী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, নাজিম হিকমতসহ আরও কত কত লেখকদের লেখা কম বেশি পড়েছি আমি। এখনও পড়ছি। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ মনে ভীষণ দাগ কেটে গেছে। সাম্প্রতিক কালে আমাকে যে বই দু’টি ভয়ঙ্কর ভাবে এলোমেলো করে দিয়েছে তা হলো নীলিমা ইব্রাহীমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। ম্যক্সিম গোর্কীর ‘মা’ সুরমা আক্তারের ‘বীরাঙ্গনা সমগ্র’। কত কত কালজয়ী উপন্যাস আমাকে আমি হতে আলগা করে ফেলে। আবার আমিকে টেনে টেনে নিজের সাথে জোড়া লাগায়। মনে হয় আহা জীবন! তুমি কত কত রং বাটো, রং মাখো রংয়ের দুনিয়ায়। দিন শেষে এ রঙিন জীবন সাদা-কালো হায়! আহা জীবন!
তরুণ বা আগ্রহী লেখকদের প্রতি আপনার সাজেশন কি? তাদের জন্য কোনো পরামর্শ অনুভব করেন কি না?
নাজনীন নাহার : পরামর্শ দেয়ার মতো পরিপক্কতা বা সময় আমার এখনও আসেনি। আমি নিজেকে এখনও লেখালেখির কৈশোরেই দেখতে পাই। তারুণ্য ছুঁই ছুঁই করেও ছুঁতে পারছি না এখনও আমার লেখালেখিতে। তবুও এই সময়ের অভিজ্ঞতায় কিছু উপলব্ধির কথা বলি। তা হলো আমরা এখন ভীষণ বেশি অধৈর্য মানুষ। অধৈর্য অধিকাংশ শিল্পীরাও। খুব সহজে সর্টকাট করে তাড়াহুড়োায় পৃথিবীর আইডল হতে চাই। চাই নাম, যশ, খ্যাতি অর্জন করতে। পরিশ্রম, অধ্যবসায় এগুলো এখন পুঁথিগত ইতিহাস। একটা দু’টো উপন্যাস, গল্পের বই বা কবিতার বই লিখেই দিবাস্বপ্ন দেখি হাজার হাজার পাঠকদের লাইন আমার বইয়ের স্টলে। সকলে হুমায়ুন আহমেদ হবে না কেউ কেউ আহমেদ সফা হবে। কেউ নাজনীন নাহার হবে। কেউ হবে অন্য কেউ। এটা অনুধাবন করতে হবে। করতে হবে নিজস্বতা গঠনের একাগ্র প্রয়াস। আমাদেরকে সর্টকাট সফলতার প্রবনতা পরিহার করতে হবে। লেখালেখির ক্ষেত্রে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই বলে লেখা থামিয়ে শুধু পড়ায় ডুবে যাওয়া নয়। মাঝে মাঝে পড়া থেকে মাথা তুলে লিখতেও হবে নিয়মিত। আমি তো বলব যখন যা মনে আসে মাথায় আসে শালীনতা বজায় রেখে লিখতে হবে। নিজের লেখাটা বারংবার একজন বোদ্ধা পাঠক হিসেবে পড়তে হবে। মূল্যায়ন করতে হবে। নিজেকেই নিজের অতিক্রম করতে হবে। অতিক্রম করতে হবে নিজের সকল সীমাবদ্ধতা। অতিক্রম করতে হবে নিজের সৃষ্টিশীলতায় নিজের সৃষ্টিশীলতাকে। মানুষ পড়তে হবে। মানুষের সুখ দুঃখ, বোধ, চৈতন্য মানুষ ভেদে বিভিন্ন প্রকৃতির হয়। এই প্রকৃতিগুলের সাথে সখ্যতা গড়তে হবে। পরিচিত হতে হবে। মানুষ, ঘটনা, পরিস্থিতি, সময় এবং মানুষের আচরণকে নিয়মিত গভীর উপলব্ধিতে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মানবিক গুণাবলীতে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। শুদ্ধ দিল এবং বিশুদ্ধ বোধের সন্তরণ একজন লেখককে সত্যিকারের সু-সৃষ্টিতে সফল করবে। তাই পরিচ্ছন্ন চিন্তা চেতনাকে ধারণ ও লালন করতে হবে। সৃষ্টির প্রেমে ডুবতে হবে। যে যত গভীরতায় ডুববে সে ততটাই মুক্তো তুলে আনতে পারবে সৃষ্টির বা সৃজনের ঝিনুক খুলে। তাই একাগ্রতা, বিশ্বাস, অধ্যবসায়, প্রেম, লেগে থাকা, পরিশ্রম ও গভীর আত্ম নিমগ্নতা জরুরি একজন লেখকের। তাহলেই সৃষ্টির সমৃদ্ধি সম্ভব। মনে রাখতে হবে সৃষ্টির সমৃদ্ধিই সৃষ্টির হয়ে কথা বলবে সকলের সাথে, সময়ের সাথে।
নিজের লেখালেখি এবং তরুণ লেখকদের নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
নাজনীন নাহার : কথা ও কাজের সামঞ্জস্যতা আনয়ন করা সকলের মধ্যে জরুরি একটা বিষয় । চিন্তা ও কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। ধৈর্য ও একাগ্রতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন সকলের। একে অপরের প্রতি সম্মান বৃদ্ধি করতে হবে। হিংসা পরিহার করা বাঞ্চনীয়।
আপনার পরিবারের বিষয়ে জানতে চাই।
নাজনীন নাহার : আমার জন্ম শরীয়তপুর জেলায়। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার শুরুও শরীয়তপুরে, সমাপ্তি ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমফিল করেছি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলএলবি করেছি। আমার বাবা ছিলেন ব্যাবসায়ী, আর মা ছিলেন গৃহিনী। বাবা-মা উভয়ই এখন প্রয়াত। আমরা দুই ভাই তিন বোন। ভাইয়েরা ব্যাবসায়ী, বোনেরা গৃহিনী। স্বামী সন্তান নিয়ে ঢাকায় বসবাস করি। খুবই সাধারণ জীবন যাপনের একজন সাধারণ মানুষ আমি, এইতো।
আপনার রচিত প্রকাশিত এবং প্রকাশিতব্য গ্রন্থগুলো কি কি?
নাজনীন নাহার : আমার লেখা প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থ ২০টি। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ ‘মৌনতা’ (২০২০) ‘নীলাদ্রি প্রণয়’(২০২০), ‘সভ্যতার বায়োগ্রাফি’(২০২০), ‘কবিতার কৈশোর’ ( ২০২২),‘কবিতার অরণ্যে একদিন’ ( ২০২১), ‘কবিতার আঁচল’ ( ২০২২), গল্পগ্রন্থ ‘অনন্ত অপেক্ষা’(২০২০), অনুগল্পগ্রন্থ ‘অভিতাপ’( ২০২০) অনুকাব্য ও অনুকথা গ্রন্থ ‘দীপ্ত সায়র’( ২০২০), ‘মিহিদানা দুঃখ সুখ’ ( ২০২১), পত্রগ্রন্থ ‘চিঠির কোলাজ’ ( ২০২১), উপন্যাস ‘জলময়ূর’ ( ২০২১), ‘নীল নিঃশ্বাস’ (২০২২), সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্প, কাব্য কবিতায় লেখা গ্রন্থ ‘বেনারসি প্রণয়’ ( ২০২১), শিশুতোষ ছড়া গ্রন্থ ‘সোনামণিদের কলরব’ ( ২০২২) প্রভৃতি। এছাড়া যেসব গ্রন্থ এবছর ২০২৩ সালে প্রকাশ হয়েছে , ‘কাদামাটির ঘ্রাণ’, ‘বীরাঙ্গনাকে লেখা চিঠি’ ও ‘চিঠির পাঁচফোড়ন’। অচিরেই প্রকাশ হতে যাচ্ছে কথোপকথন গ্রন্থ ‘না ফুরোনো বিকেল’, কাব্যগ্রন্থ ‘তোমাকে বলা হয়নি’, ‘অমিশ্র অনুরাগ’,‘কৈশোরের কলতান’, ‘জোনাক জোছনার নীলে’, উপন্যাস ‘ঘাসেদের ফাগুন’ প্রভৃতি।
আকাশজমিন/এসএ