আকাশজমিন প্রতিবেদক: রাজধানীবাসীকে মশা থেকে রক্ষায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আয়োজনের শেষ নেই। মশা মারতে প্রতিবছরই বরাদ্দ বাড়ে, সেই সঙ্গে মশাও বাড়ে। সিটি করপোরেশন দুটি এ খাতে গত ৯ বছরে ব্যয় করেছে ৬৩৬ কোটি টাকা। তবে এর সুফল পায়নি নগরবাসী। এ নিয়ে প্রতিবছরই সমালোচনার মুখে পড়তে হয় মেয়রদের।
কীটতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তারা একাধিকবার রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনকে কীটনাশক প্রয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন করতে বলেছেন। কিন্তু তারা তা শোনেনি।
‘মশা মারতে কামান দাগা’ প্রবাদের প্রচলন রয়েছে নগরবাসীর মুখে মুখে। কামান না হলেও মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে গত বছর আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করে উত্তর সিটি করপোরেশন। সে সময় ভিন্ন এক উদ্যোগ নেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। মশা মারতে খাল, নালা, ড্রেনসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাঙ ছেড়েছিল তারা। তাদের বক্তব্য ছিল, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য কাজে লাগিয়ে ব্যাঙগুলো পানিতে ভাসতে থাকা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে।
ফলে সেসব স্থানে মশা আর বংশবিস্তার করতে পারবে না। এ ছাড়া জিঙ্গেল বাজিয়েও মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। ২০১৭ সালে ঢাকার নর্দমাগুলোতে গাপ্পি মাছের পোনাও ছেড়েছিল ডিএসসিসি। ২০২০ সালে তিনটি জলাশয়ে ছাড়া হয় তেলাপিয়া মাছ ও হাঁস। এমন নানা উদ্যোগেও নগরবাসীকে মশার অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে পারেনি এই সিটি করপোরেশন।
২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধনে অর্থের বরাদ্দ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিবছরই বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু মশার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পায়নি রাজধানীবাসী। এতে প্রতিবছরই প্রশ্ন ওঠে, মশা মারার বরাদ্দ কার পেটে যায়? ৯ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মশা নিধনে ব্যয় করেছে ৪০৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আর দ¶িণ সিটি করপোরেশনের ব্যয় ২৩০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
ঢাকা দ¶িণ সিটি করপোরেশনে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যয় হয় ১১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ব্যয় ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও ব্যয় হয় ১৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয় ১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২৬ কোটি টাকা, ব্যয় হয়েছে ১৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ব্যয় করা হয় ২৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এ বছর মশক নিয়ন্ত্রণে যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদ ৭ কোটি টাকা বাজেট ছিল। সেখানে ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় মশক নিধনে। এর বাইরে মশক নিধন যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশা নিধনে বাজেট রাখা হয় ৪৫ লাখ ৭৫ কোটি টাকা।
এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মশা নিধনে ব্যয় হয় ১০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ব্যয় হয় ১৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা বাজেটের বিপরীতে ব্যয় হয় ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজেট ছিল ২১ কোটি টাকা, ব্যয় করা হয় ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ছিল ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ব্যয় করা হয় ৫৮ কোটি টাকা। ওই বছর মশক নিধন যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ খরচ করা হয় ৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫০ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যয় হয় ১১০ কোটি টাকা। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ১০১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে এই সিটি করপোরেশন।
ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়াসহ ১৩ ধরনের রোগ ছড়ায় মশা। বিশেষজ্ঞরা জানান, অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, অপরিচ্ছন্নতা, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে মশার পরিমাণ এবং প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ¶মতা বেড়েছে বহুগুণ। তাই এখন প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহার করেও মশা কমানো যাচ্ছে না। তবুও বাজেটের বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে শুধু কীটনাশক কোটি কোটি টাকার ক্রয়ে। মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক প্রয়োগ মূলত তৃতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম। এর আগের গুরুত্বপূর্ণ আরও দুটি পর্যায় রয়েছে। এগুলো হলোÑ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ। এটি বাদ রেখে সিটি করপোরেশন কীটনাশকের প্রতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
দুই সিটি করপোরেশন বিগত পাঁচ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণে ৪১০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ কোটি টাকায় ব্যয় কীটনাশক ক্রয়ে। এই সময়ে ডিএনসিসি ১৫৩ কোটি ও ডিএসসিসি ১৩৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকার কীটনাশক কিনেছে। এ থেকে দেখা যায়, কীটনাশকের ওপরই বেশি নির্ভরতা তাদের।
নগরবাসী বলছেন, নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানো হয় না। নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ এ কার্যক্রম। মশক নিধন কর্মীরা যেসব ওষুধ ছিটায়, তাতে ধোঁয়া ছাড়া কিছুই নেই। ওষুধের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। বছর বছর ব্যয় বাড়িয়েও মশক নিয়ন্ত্রণের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিবছরই ভয়াবহ আকার ধারণ করে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ নানা মশাবাহিত রোগ।
আকাশজমিন/এসআর