আকাশজমিন প্রতিবেদক: বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল, পানি- সম্প্রতি সবকিছুরই দাম বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সব ধরনের পণ্যের দাম। নতুন বছর আসতেই বাড়তি খরচের মিছিলে যোগ হয়েছে বাসা ভাড়া। রাজধানীর প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ থাকেন ভাড়া বাসায়। খরচের চাপে এমনিতেই নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ চিড়েচ্যাপটা। এর ওপর নতুন করে বাসা ভাড়া বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সবাইকে চিন্তায় ফেলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘কভিড-১৯ বাংলাদেশ : জীবিকার ওপর অভিঘাত ধারণা জরিপ’ বলছে, মহামারির প্রথম চার মাসে বেকারত্ব বাড়ে ১০ গুণ। আর্থিক সংকটে পড়া ৪৬ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার স য় ভেঙে এবং ৪৩ শতাংশের বেশি পরিবার আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় সে সময় সংসার চালিয়েছে। করোনাকালে অনেক বাড়িওয়ালা স্বেচ্ছায় ঘর ভাড়া কমিয়েছিলেন, অনেকে আবার মানবিক দিক চিন্তা করে বাড়াননি ভাড়া।
করোনার ধাক্কা শেষ না হতেই ২০২২ সালের মার্চে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাড়তে থাকে একের পর এক পণ্যের দাম। এর মধ্যেই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার খবর। গত আগস্টে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায় ডিজেল-পেট্রোলের দাম। এর প্রভাব পড়ে সব খাতে। এর পর একে একে বাড়ে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। এর ফলে সংসার চালাতে গিয়ে খাবি খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, সেভাবে বাড়েনি আয়। অনেক ¶েত্রে কারও কারও
আয় কমেছে। ফলে যারা বাড়ি ভাড়া দিয়ে সংসার চালান, তাদেরও খরচ বেড়েছে। এসব কারণে তারাও বাড়ি ভাড়া বাড়াতে শুরু করেন। মানুষের আয় না বাড়ায় আগে যে ব্যক্তি তিন রুমের ফ্ল্যাটে থাকতেন, এখন তিনি দুই রুমের ফ্ল্যাট খুঁজছেন। ঢাকায় টিকতে না পেরে কেউ কেউ পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। অনেকে আবার খাবার ও বিনোদন খরচে লাগাম টানছেন। কম দামি পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন।
ভাড়াটিয়াদের ক্ষোভ : ঝিগাতলার মুন্সীবাড়ি রোডে ২৩/৯ হোল্ডিংয়ে থাকা কামরুল হাসান বলেন, গেল চার বছরে তার বেতন না বাড়লেও বাসা ভাড়া বেড়েছে কয়েকবার। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি আর স্যুয়ারেজ বিলের সঙ্গে প্রতিবছর বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। এই জানুয়ারি থেকে ২ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়েছেন বাড়ির মালিক।
একই অভিযোগ ওয়ারীর ১৬৯/১ লালমোহন শাহ স্ট্রিটের ভাড়াটিয়া সরকারি চাকরিজীবী সোহেল চৌধুরীর। তিনি জানান, চারতলার তিনটি বেড রুম ডাইনিংসহ ফ্ল্যাটটির শুরুতে ভাড়া ছিল ১৮ হাজার টাকা। ২০১৯ সালের পরে তিন বছরে ভাড়া বেড়ে এখন ২৩ হাজারে ঠেকেছে।
বসুন্ধরা শপিং মলের পেছনের ১৬/ডি গার্ডেন রোডের শিরিন ভিলার ভাড়াটিয়া সিএনজি স্টেশনের কর্মী সাদাকাত বলেন, বাসা ভাড়াসহ সবকিছুরই দাম বাড়ায় এখন ওভারটাইম করছি প্রতিদিন। তাও কুলিয়ে উঠতে পারছি না।
নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই : বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়ালেও নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। ভাড়া নির্ধারিত হয় বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার আলোচনার ওপর। নগরবাসীর নাগরিক সুবিধাদানের সঙ্গে সম্পৃক্ত সিটি করপোরেশনেরও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মুখপাত্র আবু নাছের বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ে সিটি করপোরেশন কোনো কাজ করে না। ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষায় তিনটি সংগঠনের নাম পাওয়া গেলেও এগুলোর কোনোটিরই কার্যকারিতা নেই। এ তিন সংগঠনের কোনো অস্তিত্বও মেলেনি।
তবে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘আমরা যারা ভাড়া বাসায় থাকি, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই মুহূর্তে ভাড়া বাড়ানো কাঙ্ক্ষিত না। এখন চাহিদা বাড়লে বাড়িওয়ালারা তো সুযোগ নেবেই। আমার ভবনের কিছু ফ্ল্যাট করোনার সময় খালি ছিল, এখন নেই। বাড়িওয়ালাদের মধ্যে ভালোও আছে, মন্দও আছে। ভাড়া বাড়ার বিষয় নির্ভর করছে চাহিদার ওপর। ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা কারও পক্ষেই সম্ভব না। আমরা বললেও কেউ কথা শুনবে না। আবার দুয়েকজন বাড়িওয়ালাও আমাকে বলছে, আমাদেরও তো চলতে হয়। গ্যাসের দাম বাড়ছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ছে তাহলে আমরা কী করব? আমরা আশা করি, বাড়ি ভাড়া যেন অযৌক্তিক না হয়, একটি সহনীয় পর্যায়ে থাকে।’
আইন ভাড়াটিয়াবান্ধব নয় : বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯১) বেশিরভাগ বিধানই ভাড়াটিয়াবান্ধব নয়। আবার ভাড়াটিয়ার অনুকূলে থাকা ধারাগুলোও বাড়ির মালিকরা মানতে চান না। আইনের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে কোনো বাড়ির মালিক এক মাসের ভাড়া অগ্রিম ছাড়া আর কোনো জামানত, প্রিমিয়াম বা সেলামি নিতে পারবেন না। তবে অনেক বাড়ির মালিক দুই মাসের অগ্রিম ছাড়া বাড়ি ভাড়া দেন না। এমনকি ছয় মাসের ভাড়া অগ্রিম নেয়ারও নজির রয়েছে। ২৩ ধারায় বলা আছে, এক মাসের বেশি ভাড়া অগ্রিম বা জামানত নিলে এক মাসের ভাড়ার তিন গুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বাড়িওয়ালা। তবে অনেকে বেশি ভাড়া অগ্রিম নিলেও কোনো বাড়িওয়ালার এই দায়ে দণ্ডিত হওয়ার নজির নেই।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন একটা থাকলেও সেটা যুগোপযোগী নয়। মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণের কথা আইনে বলা হলেও সেই মানসম্মত কীভাবে বা কারা নির্ধারণ করে দেবে, তারও উল্লেখ নেই। আইনটি ভাড়াটিয়াবান্ধবও বলা যায় না।
আকাশজমিন/এসআর