আকাশজমিন প্রতিবেদক: বৈধ অস্ত্রের অনৈতিক ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় প্রশাসনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈধ অস্ত্র মালিকরা শর্ত মানছেন না। তাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করে জনমনে ভীতি সৃষ্টি করছে। যেখানে সেখানে তারা অস্ত্র ব্যবহার করছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠছে বেশি। ইতোমধ্যে ৫ হাজার অস্ত্র ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় তাদের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। পাশাপাশি সব লাইসেন্সধারীর অস্ত্রগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে তাও তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে। অনেকের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নবায়ন করছেন না। তা ছাড়া ডেটাবেজ তৈরির করারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
অস্ত্রগুলোর বিষয়ে তদন্ত করতে সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতর থেকে রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), জেলার পুলিশ সুপার ও ইউনিট প্রধানদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
অভিযোগ আছে, বৈধ অস্ত্র দিয়ে চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ভয়ভীতি দেখানো, আধিপত্য বিস্তার, পূর্বশত্রুতা, জমিজমার বিরোধ ও অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন অনেকে। কোমরে অস্ত্র গুঁজে চলাফেরা করেন কেউ কেউ। বৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারও বেড়ে গেছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ গণমাধ্যমকে বলেন, যারা বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছেন তারা পুরো শর্ত মেনে চলতে হবে। যারা শর্ত মানবেন না তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আমরা তথ্য পাচ্ছি অনেকে বৈধ অস্ত্র অনৈতিক কাজে ব্যবহার করছেন। এসব তথ্য আমরা তদন্ত করছি। পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রধারীদের ধরতেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বৈধ অস্ত্র ব্যবহারকারীরা কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহারকারীরা আইন মানেন না। তারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অপকর্ম করছেন। রাজনৈতিক নেতারা অপপ্রয়োগ করছেন বেশি। তারা কথায় কথায় অস্ত্র প্রকাশ্যে দেখিয়ে ভীতি সৃষ্টি করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনৈতিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। ইতোমধ্যে যাদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তাদের বিষয়ে তদন্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত ছয় বছরে অন্তত পাঁচ হাজার লাইসেন্সধারীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। তাদের বিষয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। বেশিরভাগ অভিযোগেরই সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। এসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। ইতোমধ্যে সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই পর্যন্ত সারা দেশে ৪৫ হাজার ২০৮টি অস্ত্রের লাইসেন্সের তথ্য সংরক্ষণ করেছে পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট। তার মধ্যে ৪১ হাজার ৫১২টি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ব্যক্তির নামে। বাকি ৩ হাজার ৬৯৬টি অস্ত্র রয়েছে আর্থিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। যেসব অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে সেগুলো হচ্ছে একনলা ও দোনলা বন্দুক, শটগান, পিস্তল, উজিগান, রিভলবার ও রাইফেল। এসব অস্ত্রের লাইসেন্স নেয়ার তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর নামও রয়েছে। এমনকি একজনের নামে একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। আর সেজন্য বৈধ ও অবৈধ অস্ত্রের ডেটাবেজ তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। ইতোমধ্যে পুুলিশের স্পেশাল ব্রা কাজ শুরু করেছে। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই এ কাজ শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ১৮৭৮ সালের আর্মস অ্যাক্ট এবং ১৯২৪ সালের আর্মস রুলসের আওতায় যে কোনো সামরিক বা বেসামরিক নাগরিককে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়। তবে লাইসেন্স পাওয়ার শর্ত আছে। সেগুলো পূরণ হলেই একজন নাগরিক লাইলেন্স পেতে আবেদন করতে পারেন। বাংলাদেশের নাগরিক ছাড়া কেউ আবেদন করতে পারেন না। কোনো বিদেশি নাগরিক আবেদন করলে সরাসরি তা বাতিল হয়ে যায়। জীবনের ঝুঁকি থাকলে কেউ আবেদন করতে পারেন। শর্ট ব্যারেল আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষেত্রে আবেদনকারীর বয়স অন্তত ৩০ বছর, লং ব্যারেল আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৬০ বছর হতে হয়।
আবেদনকারীকে অবশ্যই আয়কর দাতা হতে হয়। বছরে ন্যূনতম আড়াই লাখ টাকা আয়কর দিতে হয় তাদের। আবেদনের পর পুলিশের স্পেশাল ব্রা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করে। তদন্ত শেষ হলে আবেদনকারীর পক্ষে প্রতিবেদন গেলে যাচাই করে লাইসেন্সের জন্য অনাপত্তিপত্র দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অনুমতি পেলে আবেদনকারী অস্ত্র আমদানি করে আনতে পারেন অথবা দেশীয় বৈধ কোনো ডিলারের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে পারবেন।
তবে কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন। লাইসেন্স পেতে একজন নাগরিককে স্থায়ী ঠিকানা যে জেলায়, সেখানকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের লাইসেন্স ও আগ্নেয়াস্ত্র বিভাগ থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হয়। জেলা প্রশাসক বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদনের পর আবেদনটি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় অনাপত্তিপত্র দিলে জেলা প্রশাসক ওই আবেদনকারীর বরাবরে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করেন। এক্ষেত্রে আবেদনপত্রের সঙ্গে বৈধ নাগরিকত্বের সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, আয়কর সার্টিফিকেটের ফটোকপি, ছয় কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি এবং লাইসেন্স ফি জমা দিতে হয়।
আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬ অনুযায়ী, কেবল আত্মরক্ষার স্বার্থে ব্যক্তিগতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে কোনো নাগরিক। তবে এই নীতিমালায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে লাইসেন্স দেয়া সাধারণভাবে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। অস্ত্র পাওয়ার পর কখন পরীক্ষামূলক ফায়ার বা ফাঁকা গুলি চালাতে পারবেন, সেই সংক্রান্ত কিছু নির্দেশনাও মানতে হয়।
কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ এসব করতে পারবে না। লাইসেন্স নবায়ন করতে হলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবার আবেদন করতে হয়। কোনো ক্ষেত্রে যদি আগ্নেয়াস্ত্র মালিকের দেহরক্ষী ব্যবহার করেন, তাহলে তার নামেও লাইসেন্স থাকতে হবে। অস্ত্র হারিয়ে গেলে বা লুট হয়ে গেলে থানায় জিডি করতে হয়। আবার লাইসেন্সধারী দেশের বাইরে গেলে তাকে থানা পুলিশকে অবহিত করে যেতে হয়।
এ বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এমনও দেখা যাচ্ছে যার অস্ত্রের লাইসেন্স দরকার নেই তিনিও আবেদন করে বসছেন। আবেদন করেই তারা রাজনৈতিক তদবির শুরু করেন। তারা মন্ত্রী-এমপি ও পুলিশের বড় কর্তাদের কাছে বেশি তদবির করেন। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক নেতারাই বেশি তদবির করেন। অনেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে একটি বিকাশের দোকান থেকে ৭৫ হাজার টাকা বিকাশ করে টাকা না দিয়ে আরিফ নামে এক ব্যক্তি চলে যেতে চাইলে ব্যবসায়ীরা তাকে আটক করেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি আবদুল ওয়াহিদ ওরফে মিন্টু ও তার লোকজন আরিফকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে ব্যবসায়ীরা বাধা দেন। এ সময় মিন্টু তার লাইসেন্সকৃত পিস্তল দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি করেন। এতে দুজন আহত হন। ২০১৬ সালে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছিলেন মিন্টু।
২০২১ সালে মেয়াদ শেষ হলেও লাইসেন্স নবায়ন করেননি তিনি। পুলিশ অস্ত্রটি জব্দ এবং মিন্টুকে গ্রেপ্তার করে। লাইসেন্স বাতিল করতে পুলিশ সুপারিশ করেছে। গত বছর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যুবলীগের আহ্বায়ক ও শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজালাল মজুমদারের ওপর কথিত যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান জুয়েলের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। হামলায় চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আমজাদ হোসেন আহত হন। ওই ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনায় জুয়েলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
জুয়েলের পিস্তলটির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। চলতি মাসে ঢাকার মোহাম্মদপুরে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে জমি দখলের চেষ্টা করেন তিন ভাই। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তাদের অস্ত্রগুলোও লাইসেন্স করা ছিল বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। ইতোমধ্যে লাইসেন্স বাতিল করতে পুলিশ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে। এসব ঘটনার মতো সারা দেশে প্রায়ই বৈধ অস্ত্রের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা বলেন, নানা কারণে অন্তত পাঁচ হাজার লাইসেন্সধারীর তদন্ত শেষের দিকে। প্রতিবেদন হাতে এলে সেগুলোর লাইসেন্স বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু হবে। তা ছাড়া অস্ত্রের ডেটা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। কেউ অস্ত্র কিনলে সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রের কোডসহ থানা পুলিশকে জানাতে অস্ত্রের দোকানকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তারা আরও বলেন, রাজনৈতিক ক্যাডার ও অপরাধীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ছোট অস্ত্র। তাদের আগের তালিকায় রয়েছে উগনি কোম্পানির পিস্তল, মাউজার পিস্তল, ইতালির প্রেটো বেরোটা পিস্তল, জার্মানির রুবি পিস্তল রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, চীন, ইসরায়েল, জার্মানি ও রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে আসছে। মিয়ানমার থেকেও বঙ্গোপসাগর হয়ে আসছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে বলে জানান ওই দুই কর্মকর্তা।
তারা বলেন, আমরা প্রায়ই তথ্য পাচ্ছি কেউ কেউ বৈধ অস্ত্র ভাড়া পর্যন্ত দিচ্ছেন। তাদের তালিকাও আমরা করছি। যারা বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র দিয়ে অপকর্ম করছে তাদের ধরতে শিগগির বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে। মন্ত্রণালয় সেই বিষয়ে আমাদের বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি।
আকাশজমিন/এসআর