রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৫৭ পূর্বাহ্ন

শহিদ মিনার চাই হামিদুর রাহমানের মূল নকশা অনুকরণে

আকাশজমিন রিপোর্ট:
  • সর্বশেষ আপডেট : মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ ৫:০৭ pm

১৯৫২ সালে ভাষার আন্দোলনের ক্ষেত্রে রক্ত দানের বিষয়টি পৃথিবীর ইতিহাসে এক অসাধারণ ঘটনা। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের শহিদের স্মরণে নির্মাণ করা হয় শহিদ মিনার। বাঙালি জাতির কাছে শহিদ মিনার এমন এক অনন্য প্রতীক যার আবেদন কখনও অতিক্রম করা যায় না। এর অস্তিত্ব, এর আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা, আবেগ, এর ব্যঞ্জনা প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করে। আর ফেব্রুয়ারি এলে তো কথাই নেই, এই কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার যেন আমাদের কাছে টেনে নেয় আপন মহিমায়, অসীম ভালোবাসায়। জাতীয় জীবনের নানা ঘটনায়, ঘাত প্রতিঘাতে, প্রতিবাদে মুখর হতে, শোকদিবস পালনে আমরা ছুটে যাই শহিদ মিনারে। আজ আমরা যে শহিদ মিনারে ছুটে যাই তা ইতিহাসে একটি খণ্ডিত চিত্র মাত্র। নানা সময়ে শহিদ মিনারের উপর নেমে এসেছে বিপর্যয়। হামিদুর রাহমানের মূল নকশা অনুসারে তৈরি শহিদ মিনার ভেঙে ফেলা হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়। আর এইভাবে ভাঙা গড়ার সন্ধিক্ষণে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের খণ্ডিত শহিদ মিনার।

হামিদুর রাহমানের মূল নকশাটি ছিল ঠিক এই ধরনের। এখন আমরা মিনারের যে চারটি স্তম্ভ দেখি প্রতিটির ভিতরে লোহার শিক দেয়া হয়েছে; এটা শিল্পীর মূল পরিকল্পনায় ছিল না। পরিকল্পনায় ছিল স্তম্ভগুলোর মধ্যে থাকবে অজস্র চোখের নক্শা। লেবু, হলুদ আর গাঢ় নীল রঙের স্টেইন্ট গাস এর তৈরি হবে চোখগুলো। মিনারের সামনে প্রশস্ত জায়গায় থাকার কথা ছিল মার্বেল পাথর। এই পাথরে স্টেইন্ট গাসের বিভিন্ন রঙিন চোখের আলোকিত প্রতিফলন পড়লে সূর্যের সাতটি রঙের বর্ণালি মেঝেতে সৃষ্টি হতো। পুরো মিনারটির সামনে একটা রেলিং থাকার কথা ছিল। রেলিংটা আগাগোড়া বর্ণমালা দিয়ে তৈরি হবে।

‘একুশে ফেব্রুয়ারি, তোমায় কি ভুলিতে পারি’ এই কথাটা বার বার রেলিং-এ লেখা থাকার কথা ছিল। যে প্রশস্ত জায়গাটি মিনারের সামনে রয়েছে সেখানে বেশ কিছু রক্তমাখা পায়ের ছাপ শহিদের স্মরণে; আর কিছু বিশাল কালো পায়ের ছাপ দানবের প্রতীক হিসেবে থাকার কথা ছিল। আর এই মিনারের পাশেই থাকবে একটা বাংলা সাহিত্যের পাঠাগার, সেই পাঠাগারের দেয়ালে তৈলচিত্র থাকবার পরিকল্পনা ছিল। মিনারের সামনে থাকবার কথা ছিল সুন্দর এক ঝর্ণা। চোখের মতো অনেকটা দেখতে হতো এর আকৃতি। কালো বিরাট চোখই একটা ঝর্ণা।

 

অনবরত অশ্রুর মতো ঝরবে পানি। সেই পানি আবার জমা থাকবে। মনে হবে মহাকাল ধরে ঝরছে অশ্রুধারা। এই ঝর্ণার পর পরই বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটির প্রায় দেয়াল ঘেঁষে আবার মিনারের মতো একটা উঁচু বেদি উঠে যাওয়ার কথা। যাতে দুই দিকে ঢেউয়ের প্রতিক্রিয়া থাকে এবং একটা বিশাল এলাকাজুড়ে শহিদ মিনারের অস্তিত্বটা টের পাওয়া যায়। মিনারের গায়ে স্টেইন্ট গ্লাসের চোখ থেকে মেঝের মার্বেল পাথরে যে বর্ণালির ছ’টা পড়বে তাতে রঙের একটা কাল্পনিক ঘড়ি অঙ্কন করা যেতে পারে।

 

যেমন : আটটা বাজলে বেগুনি রং, বারোটাতে নীল, পাঁচটায় কমলা রং। এমনি দেখতে দেখতে ঘড়িটার রং পরিচিত হয়ে যেত। আর একটা ঘড়ি থাকার কথা ছিল; উঁচু টাওয়ার ঘড়ি। এর সময়গুলো লেখা হতো বাংলা সংখ্যায়। শহরের একটা প্রধান সময় দেখার কেন্দ্র হিসেবে মিনারের ঘড়ি একটা দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যেত। এক হাজার স্কয়ার ফুটের একটি ম্যুরাল পেইন্টিং যেটা মিনারের ভিতরের কুঠুরীতে থাকার কথা, যদি পেইন্টিংটা হতো তাহলে এটা পৃথিবীর দীর্ঘতম পেইন্টিংগুলোর মধ্যে অন্যতম হতো। যদি পুরো শহিদ মিনারটি শিল্পী হামিদুর রাহমানের পরিকল্পনা অনুসারে তৈরি হতো তাহলে এটা হতো অনন্য অসাধারণ একটি মিনার।

জানা যায়, হামিদুর রাহমান ১৯৫১ সালে প্যারিসের বোজ আর্ত্য স্কুলে পড়তে যান। পরে লন্ডন থেকে ১৯৫৬ সালে তিনি তার শিক্ষাজীবন শেষ করেন। তখন তার মধ্যে ছিল যৌবনের তেজ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রে¶িতে কোনো বাঙালি নিশ্চুপ থাকতে পারেনি। এমনকি শিল্পী হামিদুর রাহমানও নয়। ভাষাশহিদদের জন্য কিছু একটা করা শিল্পীর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাই তিনি দেশে ফিরে আসেন।

১৯৫৭ সালের বসস্তে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, পি. ডব্লিউ.ডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার এম.এম.জব্বার এবং শিল্পী জয়নুল আবেদিন অনুরোধ করেন শিল্পী হামিদুর রাহমানকে শহিদ মিনারের একটি পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য। অনেকেই নকশা জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু হামিদুর রাহমানের নকশাটি সিলেকশন কমিটি গ্রহণ করেন। মূল পরিকল্পনা অনুসারে কাজ শুরুর পর বিশ্বখ্যাত ভাস্কর শিল্পী নভেরা আহমেদ বাংলাদেশে আসেন হামিদুর রাহমানের অনুরোধে এবং তিনিও তিনটি ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান মার্শাল ল জারির পর শহিদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মূল নকশার অনেক কিছু বাদ রেখে শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়।

১৯৭১ সালে ২৭ মার্চ শহিদ মিনার ভেঙে দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। ১৯৭২ সালে তড়িঘড়ি করে শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়। তারপর অনেক পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু হামিদুর রাহমানের মূল নকশা অনুসারে শহিদ মিনার নির্মাণ করতে পারেনি। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম চায় শহিদ মিনার তৈরি করা হোক হামিদুর রাহমানের নকশা অনুসারে। কেননা সেই শহিদ মিনার নির্মাণ হলে জাতি পাবে এমন এক অনন্য প্রতীক যা হয়ে উঠবে গোটা বিশ্বের কাছে একটি সার্বজনীন স্থাপনা।

লেখা : আবু সুফিয়ান

 

আকাশজমিন/এসআর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন
আর্কাইভ
© All rights reserved © Akashjomin

Developer Design Host BD