আমাদের চারপাশের জড় এবং জীবের সমন্বয়, অর্থাৎ একে অপরের নির্ভরশীলতাই পরিবেশ। গোটা পৃথিবীর জীবনই পরিবেশ। সবার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সুস্থ এবং বাসযোগ্য পরিবেশ। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নানা সমস্যার আবর্তে কাটে জনজীবন। সমাজের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নানা অসঙ্গতি, অনিয়ম, দুর্ভোগ লেগেই আছে। ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশে বহুমাত্রিক এবং অন্তহীন সমস্যার মাঝেই লুক্কায়িত রয়েছে নানা সম্ভাবনা। উন্নয়নের নানা দিক হাতছানি দেয়। অগ্রগতির স্বপ্ন দেখায় নানা সূচক, নিয়ামক। তবে সময়ের পরিক্রমায় নানা অন্তরায় আর বাধাবিপত্তির মাঝেও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সারাবিশ্বের নজর কাড়ছে লাল সবুজের বাংলাদেশ।
আমাদের মতো উদীয়মান দেশগুলোতে সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এসব দেশের সার্বিক উন্নয়নে সাংবাদিকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশের নিয়মতান্ত্রিক সাংবাদিকতার তুলনায় উন্নয়নশীল দেশের সাংবাদিকতার দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। নিরপেক্ষতা কিংবা বস্তুনিষ্ঠতার চেয়ে এখানে জনগণের স্বার্থ, দেশ, জাতি ও সমাজের কল্যাণ সর্বাধিক গুরুত্ববহ। গণমাধ্যমকে থাকতে হয় বেশি তৎপর এবং সচেতন। গণমানুষের ভাবনার বিষয় নির্ধারণে গণমাধ্যমকে যথেষ্ট দক্ষতা এবং অভিভাবকের পরিচয় দিতে হয়। ঘটনার গুরুত্ব, তারতম্য, তাৎপর্য তথা সংবাদ উপযোগিতার ভিত্তিতে গণমাধ্যম আধেয় নির্মাণ করে। কিন্তু সঙ্গত কারণেই বহুমাত্রিক এবং সীমাহীন সমস্যার মাঝে অনেক সমস্যাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের গণমাধ্যমে বরাবরই রাজনৈতিক সংবাদের প্রচার এবং প্রকাশ বেশি।
রাজনীতি নিয়ে আমরা যতটা ভাবি সমাজের অন্যান্য বিষয় ততটা গুরুত্ব পায় না। এর নেপথ্যে অবশ্যই কারণ রয়েছে। এখানে সব কিছুর সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে রাজনীতি। রাজনীতির বাইরে কিংবা অভ্যন্তরে কিছু নেই। রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, কারখানা, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকসহ অন্যান্য বিষয়াবলি নিয়ে যে সাংবাদিকতার চর্চা দেখা যায়, সেখানে পরিবেশ সাংবাদিকতার প্রবণতা তেমন নজরে আসে না। অথচ আমরা যা কিছু করছি পরিবেশের ভিতর বসবাস করেই। কিন্তু সেই পরিবেশ ক্রমান্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশের সঙ্গে জড়িত আমাদের জীবনযাপন।
পরিবেশের এক উপাদানের প্রভাব অন্য উপাদানের উপর। অথচ সেই পরিবেশ সম্পর্কে আমরা কতটা সচেতন? বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রত্যেক অ লের পরিবেশের সমস্যা রয়েছে। এলাকাভেদে এই সমস্যা ভিন্নতর। পরিবেশের বিরূপ প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে প্রত্যেক অ লের মানুষ। ছয় ঋতুর দেশের সেই বৈশিষ্ট্য আর নেই। প্রকৃতি এবং জীবের বৈচিত্র্য মুছে যাচ্ছে। কিন্তু সমাজের অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক সাংবাদিকতার নিকট গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে পরিবেশ সাংবাদিকতা। গণমাধ্যমে পরিবেশ নিয়ে ব্যাখ্যামূলক, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কম, পরিবেশ সংশ্লিষ্ট সংবাদ গুরুত্বহীন। পরিবেশ নিয়ে গণমাধ্যম গণমানুষের এজেন্ডা নির্ধারণ করছে না। করলেও তা যথেষ্ট নয়।
অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিটভিত্তিক সাংবাদিকতা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে পরিবেশ বিট খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য পরিবেশের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। সব কর্মকাণ্ডের আগে আমাদের ভাবতে হবে পরিবেশ নিয়ে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ দিনদিন বিলুপ্তির পথে। অনবায়নযোগ্য সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
অনবায়নযোগ্য সম্পদের বিলুপ্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এক হিসেবে দেখিয়েছেন, ১৬০০ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত তিনশ’ বছরের প্রতি চার বছরে একটি করে প্রজাতি বিলুপ্তি হয়েছে। ১৯০০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তি হয়েছে প্রতি বছরে একটি করে প্রজাতি। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন একটি করে প্রজাতি বিলুপ্তি হয়েছে। আর বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেন প্রজাতি বিলুপ্তি হার আরো বাড়বে।
এদিকে পরিবেশ এবং উন্নয়নের মাঝে দ্বন্দ্ব বরাবরই রয়েছে। আমরা অবশ্যই উন্নয়ন চাই, তবে পরিবেশের ক্ষতি করে নয়। কিন্তু উন্নয়নের জন্য প্রকৃতিকে আমরা যতবেশি নিয়ন্ত্রণ করবো, পরিবেশ ততবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রকৃতিকে নিজের মতোই রাখতে হবে। পরিবেশ বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং গুরুত্ববহ। পরিবেশ নিয়ে গণমানুষ তেমন সচেতন নয়। কাজেই পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে রক্ষার জন্য পরিবেশ সাংবাদিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। পরিবেশ সাংবাদিকতার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। পরিবেশ এবং উন্নয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং সাংঘর্ষিক অনেক বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়ার জন্য পরিবেশ সাংবাদিকতার বিকল্প নেই। পরিবেশের প্রতিটি বিষয় গুরুত্ববহ এবং এর কোনো একটি বিষয়ের সমন্বয়হীন প্রাণিকুলের জন্য হুমকিস্বরূপ, তা পরিবেশ সাংবাদিকতার মাধ্যমেই জনগণকে সচেতন করতে হবে।
দেশ, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই গণমাধ্যমে পরিবেশ সাংবাদিকতার আওতা বাড়াতে হবে। পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক তথ্য পরিবেশন, জ্ঞান দান, শিক্ষা দেয়া, উদ্বুদ্বকরণ এবং টেকসই উন্নয়নের কাজ করা সাংবাদিকের অন্যতম দায়িত্ব। আমাদের এখানে সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের পেশাগত দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। অনেক কিছুই কর্তা-ব্যক্তির চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু এখানকার সাংবাদিককে অধিকতর চৌকস হতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হিসেবে নয়, পরিবেশ সাংবাদিকতা দায় ব্যক্তিগত দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
পরিবেশ সংরক্ষণে সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। সমাজের আর অন্য দশটি সমস্যার সঙ্গে পরিবেশের সমস্যাকে সমান গুরুত্ব দেয়া দরকার। কেননা পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর প্রভাব কোনো অংশে কম নয়। তবে বর্তমানে পরিবেশ নিয়ে খবরাখবর কিছুটা হলেও বেড়েছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করছে। তারা পরিবেশ সাংবাদিকতার বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করছে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিবেশ সাংবাদিকতা নামে আলাদা কোর্স পড়ানো হচ্ছে। এছাড়াও পরিবেশ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরিবেশ সাংবাদিকতা গণমাধ্যমের কর্তা-ব্যক্তিদের নজরে আসা বা নীয়। সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদকসহ গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল মানুষগুলোর উদার মনমানসিকতায় বিকশিত হতে পারে পরিবেশ সাংবাদিকতা। প্রত্যাশা কেবল একটাই বেঁচে থাকুক মানুষ, বেঁচে থাকুক প্রকৃতি।
আকাশজমিন/এসআর