আকাশজমিন প্রতিবেদক।। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার তাঁর। তার ক্যারিয়ার এত সমৃদ্ধ যে আজও তাঁকে এবং তার কাজকে, তাঁর শৈল্পিকতাকে ছুঁতে পারেনি কেউ। তিনি জীবদ্দশায় নানা সময় কাছের মানুষজন সহকর্মীদের সঙ্গে অবসরে, আড্ডায়, আলাপে জীবন নিয়ে, জীবন বোধ নিয়ে, মানুষের জীবন সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক
তত্ত্ব কথা বলেছেন। বলা যায় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাণী দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন ‘জীবন মানে হচ্ছে ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া’। তিনিও কাজ করতে করতে এক সময় প্রেম ও বিরহের পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ওই দুরপারে। আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি সোমবার তাঁ চিরতরে চলে যাওয়ার দিন। ২০১২ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান । তিনি হুমায়ুন ফরীদি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে বিশেষ করে অভিনয়শিল্প জগতের কিংবদন্তি হুমায়ুন ফরীদি। অথচ আজকের দিনে কোনও আনুষ্ঠানিক আয়োজনের খবর পাওয়া যায়নি। অথচ অভিনয়ের এমন কোন দিক নাই যেখানে তিনি অবদান রাখেননি। কি মঞ্চে, কি টিভি নাটকে, কি চলচ্চিত্রে! তিন মাধ্যমেই তিনি ছিলেন সেরা এবং সেরাদের সেরা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার ক্যারিয়ারে গৌরবময় অধ্যায় রয়েছে। জাতীয়ভাবে তাকে তেমন করে মনে করা না হলেও স্বাভাবিক নিয়মে পারিবারিকভাবে তাকে স্মরণ করা হবে। আর ভক্ত-সহকর্মীদের মনে তো তিনি চিরভাস্মর। তারাই তাঁকে স্মরণ করবেন দিনভর, জীবনভর।
পুরান ঢাকার নারিন্দায় ১৯৫২ সালের ২৯ মে জন্মেছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। তার বাবার নাম এটিএম নুরুল ইসলাম, মায়ের নাম বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে ফরীদি ছিলেন দ্বিতীয়। হুমায়ুন ফরীদির প্রকৃত নাম হুমায়ুন কামরুল ইসলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সেলিম আল দীনের কাছ থেকে নাট্যতত্ত্বে দীক্ষা নেন হুমায়ুন ফরীদি। এরপর ডাক পান ঢাকা থিয়েটারে। সেখান থেকেই বিকশিত হয় তার অভিনয়ের দ্যুতি। মঞ্চ দিয়ে শুরু হওয়া সেই যাত্রা চলচ্চিত্র টিভি নাটকে সমৃদ্ধ অবস্থানে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। কারণ তিনি বিস্ময়ের চেয়ে কম ছিলেন না! ১৯৮০ সালেটিভি নাটকে তার অভিষেক হয়। প্রথম নাটকটির নাম ‘নিখোঁজ সংবাদ’
তবে দেশজুড়ে হুমায়ুন ফরীদির জনপ্রিয়তা আসে ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’ দিয়ে। এখানে তিনি কানকাটা রমজান চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি নাটক হলো- ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘শৃঙ্খল’, ‘প্রিয়জন নিবাস’ ইত্যাদি।পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে হুমায়ুন ফরীদির প্রথম কাজ শেখ নিয়ামত আলী নির্মিত ‘দহন’। এটি ১৯৮৫ সালে মুক্তি পেয়েছিলো। প্রথম সিনেমা দিয়েই সেরা অভিনেতা বিভাগে বাচসাস পুরস্কার জিতে নেন তিনি। নব্বই দশকে তিনি সিনেমার খল চরিত্রে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পান। ‘সন্ত্রাস’, ‘দিনমজুর’, ‘বীরপুরুষ’, ‘লড়াকু’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে তার অভিনয় ভয় ধরিয়েছিলো দর্শকমনে। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে সফলতম নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন ক্যারিয়ারে ২৮টি চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন। এর মধ্যে ২৫টিতেই রেখেছেন হুমায়ুন ফরীদিকে। নন্দিত এই তারকার আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো- ‘একাত্তরের যীশু’, ‘দূরত্ব’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘অধিকার চাই’, ‘ত্যাগ’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘মাতৃত্ব’, ‘আহা!’ ইত্যাদি।দর্শক থেক অভিনয় অঙ্গন, সবখানেই উচ্চমর্যাদা পেয়েছেন হুমায়ুন ফরীদি। তবে তার পুরস্কারভাগ্য মন্দই বটে। লম্বা ক্যারিয়ারে তাকে মাত্র একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। সেটা ২০০৪ সালের ‘মাতৃত্ব’ ছবির জন্য। ২০১৮ সালে এ অভিনেতাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে।
হুমায়ুন ফরীদির ব্যক্তিগত জীবনের দর্শনও অনেকের কাছে মুগ্ধতার নাম। আশির দশকে ফরিদপুরের মেয়ে মিনুকে বিয়ে করেন তিনি। এই সংসারে দেবযানি নামে এক কন্যা রয়েছে তার। এরপর ফরীদি ঘর বাঁধেন নন্দিত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে। ২০০৮ সালে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। গাছে গাছে ফুলের অস্তিত্ব জানান দেয়, প্রকৃতিতে বসন্ত এসে গেছে। কিন্তু দেশের অভিনয় জগতে এক দশক আগেই ¤øান হয়ে গেছে ফাগুনের রঙ। কারণ বসন্তের শুরুতেই হয়েছিলো অভিনেতাদের অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির জীবনাবসান। তাই বসন্ত এলেই সিনেপ্রেমী দর্শকের মনে, অভিনয়প্রিয় শিল্পীদের ভাবনায় বিষাদের ফুল হয়ে ফোটেন এই কিংবদন্তি।
সময়টা উত্তাল একাত্তর। দেশে চলছে স্বাধীনতা অর্জনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানিক কেমিস্ট্রির ছাত্র। দেশের এমন ক্রান্তিকালে হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। পড়াশোনা ছেড়ে রাইফেল কাঁধে তুলে নেমে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। বীরের মতো লড়াই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীনের পর তিনি ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই শুরু হয় স্নাতক পর্বের নতুন জীবন। আর সবুজ প্রকৃতি ঘেরা ওই ক্যাম্পাসেই বিকশিত হয় তার অভিনয়ের সুপ্ত প্রতিভা। যা একসময় জ্বালাময়ী অগ্নিশিখায় পরিণত হয়। পরবর্তী একাধিক প্রজন্মের কাছে তিনি পরিচিতি পান অভিনয়ের আদর্শ, প্রতিষ্ঠান কিংবা স্কুল হিসেবে। যুদ্ধের ময়দান থেকে অভিনয়ের ভুবন, সবখানে বীরত্বের ছাপ রেখে যাওয়া সেই মানুষটি হুমায়ুন ফরীদি। প্রয়াণ দিবসে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আকাশজমিন/এসএ