খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদা। খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। অন্যান্য যন্ত্রের মতো মানবদেহও একটি ইঞ্জিন। যার চালিকাশক্তি খাবার। কিন্তু সেই খাদ্য অবশ্যই হওয়া চাই স্বাস্থ্যসম্মত তথা মানবদেহের উপযোগী।
আমরা কি আসলেই মানবদেহের উপযোগী ভেজালমুক্ত খাবার গ্রহণ করছি! গণমাধ্যমে প্রায়ই ভেজাল খাদ্য বিষয়ক প্রতিবেদন দৃষ্টিগোচর হয়।
মাঝেমধ্যেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন দোকান, হোটেল, অভিজাত রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে পচা, বাসি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ভেজাল বা বিষাক্ত দ্রব্য জব্দ করে এবং জেলজরিমানা দেয়।
এছাড়াও সর্বত্র ভেজাল খাদ্যের রমরমা ব্যবসা। ভেজালের এই ভয়াবহ চিত্র স্বাভাবিকভাবেই ভয় ও উদ্বেগের জন্ম দেয়। বেঁচে থাকার তাগিদে জেনেশুনে ভেজাল খাবারই খেয়ে যাচ্ছি। যা বিষপানেরই স্বরূপ। এই বিষপানে মৃত্যু তাৎক্ষণিকভাবে হয় না। মৃত্যু হয় ধীরে ধীরে দেহে নানা রোগবালাইকে আশ্রয় দিয়ে।
ভেজাল খাবার এড়িয়ে চলার উপায় নেই। বাইরের খাবার এড়িয়ে কেবল ঘরে রান্না করা খাবার খেলেই ভেজাল খাবার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। কারণ ঘরের খাবারের উপকরণ বাইরে থেকেই আনতে হচ্ছে।
বর্তমানে মানুষের খাদ্যাভাসে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। বাইরের নানা রকমের মনের মতো খাবার আমাদের রুচিবোধ বদলে দিচ্ছে। কাজেই নানা কারণে বাইরে খেতেই হচ্ছে। খাদ্য ভেজালের চিত্র বৈচিত্র্যপূর্ণ।
জমিতে খাদ্যশস্য ফলানোর সময় থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা, সংরক্ষণাগারে প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারে বিক্রি এবং রান্না করার সময় মেশানো হচ্ছে ভেজাল। গরু মোটাতাজাকরণে ঔষধ, মাছে ও খাদ্যে পচনরোধে বিষাক্ত ফরমালিন, দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলে বিষাক্ত কেমিক্যাল এবং শাকসব্জিতে কার্বাইড মেশানো নতুন কিছু নয়।
জিলাপি-চানাচুরে মবিল, বিস্কুট, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিংক্স, জুস, সেমাই, আচার, নুডুলস এবং মিষ্টিতে টেক্সটাইল ও লেদার রং, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজ, পানিতে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, লেড, ইকোলাই। ভেজাল নেই কোথায় বলা মুশকিল। নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে ভেজাল ও নকল পণ্য। বাজারে আসল নকলের তফাত বোঝা বড় দায়।
দুধ, মিষ্টি, সেমাই, জুস, শরবত, ফল, ভোজ্যতেল, মসলা, মুড়ি ও ইফতারের বিভিন্ন মুখরোচক উপাদান, জিলাপিসহ ফল ও শাক-সবজির মধ্যেও মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। কাউন ও কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে মসলা তৈরি করা হয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফুটপাতের দোকান ক্যান্টিনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্নাকরা পচা ও বাসি খাবার, আবার মরা মুরগির মাংসও মিলছে।
এছাড়া নানাভাবে নানা উপায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সাধারণ মানুষ তথা ভোক্তাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে খাদ্যে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। আর এই সব ভেজালের নেপথ্যে রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। যাদের লক্ষ্য অধিক মুনাফা অর্জন করা। ভেজাল খাদ্যের ভয়াবহতা ব্যাপকতর। ভেজাল খাদ্য মানবদেহের জন্য বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ।
সমাজের সকল শ্রেণি পেশার ও বয়সের লোক ভেজাল খাদ্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেশি ¶তির শিকার শিশু। বর্তমানে মানবদেহে নিত্যনতুন রোগবালাই বাসা বাঁধছে। যার কারণ ভেজাল খাদ্য। দূষিত খাবার মানব দেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যা এক সময় মৃত্যুর কারণও হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে এদেশে বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগসহ ডায়রিয়া, ক্যান্সার, হৃদরোগ, বিভিন্ন জন্মগত সমস্যার জন্য ভেজাল খাদ্য গ্রহণই দায়ী।
খাদ্যে ভেজাল অমানবিক ও ¶মার অযোগ্য অপরাধ। জাতিকে সুস্বাস্থ্যবান এবং দক্ষ মানবশক্তি তৈরি করার জন্য ভেজালমুক্ত খাবার নিশ্চিত করতে হবে। অসাধু এবং মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের মাঝে নীতি নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করা দরকার। ভেজালবিরোধী অভিযান কেবল নির্দিষ্ট সময় নয়, সব সময় চালু রাখতে হবে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ jক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়া ও ভেজাল খাদ্য বিক্রি করার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে।
ভেজাল খাদ্য বিরোধী আইন বিধিবিধানের বাস্তবায়ন করতে হবে। এব্যাপারে সবার মাঝে সচেতনতা তৈরি করা দরকার। মনে রাখতে হবে, সবার আগে দরকার মানবদেহ নামক ইঞ্জিনকে সচল রাখা আর এর জন্য দরকার ভেজাল তথা বিষমুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য।
আকাশজমিন/এসআর