আকাশজমিন প্রতিবেদক: পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের পশ্চিম সোনাতলা গ্রামের হাসান পারভেজ (৪০)। কখনো ইটভাটায় কাজ করে, কখনো নদীতে মাছ ধরে, আবার কখনো খেতখামারে দিনমজুরি করে সংসার চালান তিনি। এ ছাড়াও অনেক পরিচয় আছে তার। তিনি একাধারে সংবাদপত্রের সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশক।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাতে লিখে চার পৃষ্ঠার একটি পত্রিকা বের করেন হাসান পারভেজ। পত্রিকার নাম আন্ধারমানিক। তাতে যেমন যে মানিক আঁধারে ঢাকা পড়ে আছে, আবার আঁধারেও যে মানিক জ্বলজ্বল করে। আমরা দুটি অর্থই হাসান পারভেজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি। নিভৃত প্রান্তিক গ্রামের নিতান্তই একজন শ্রমজীবী মানুষ হয়ে যে কাজটি তিনি করছেন তা মানিকের মতো তো বটেই। অর্থাৎ নিভৃতপল্লিতে অন্ধকারের মধ্যেই যেন জ্বলজ্বল করছে একটি মানিক। শিক্ষার অভাব, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এ নিভৃতপল্লিতে হাসান পারভেজের আন্ধারমানিক পত্রিকা যেন অন্ধকারের আলো।
হাসান পারভেজের মতে, এটি একটি কমিউনিটি পত্রিকা। হত্যা, খুন, ধর্ষণের মতো নেতিবাচক কোনো খবর থাকে না হাসানের পত্রিকায়। থাকে ইতিবাচক, ভালো খবর। গ্রামের একেকজন মানুষের জীবনের গল্প একেক রকম। কারও সফলতার, কারও প্রাপ্তির, কারওবা রয়েছে সুখ-দুঃখের গল্প। সেই গল্পগুলোকে হাসান নিপুণ শিল্পীর মতো তুলে ধরেন তার হাতের লেখা এ পত্রিকায়।
হাসানের স্ত্রী শাহনাজও তাকে এ কাজে সহায়তা করেন। শাহনাজ দুঃখ করে বললেন, ‘অনেক কষ্টে আমাগো সংসার চলে। বাড়িতে ডাল নাই, চাল নাইÑ পোলামাইয়া কী খাইবে সেদিকে হাসানের খেয়াল নাই। কিছু বললেই বলে, ওরা গরিব ওদের কথা বলার কেউ নাই, আমাদের আল্লায় দেবে। ’ তার সব চিন্তা এ গ্রামের অসহায়-গরিব মানুষদের নিয়ে। তাদের খবর দিয়েই সাজান পত্রিকা। যে খবরে কোনো অসত্য তথ্য নেই, নেই কোনো তথ্য বিকৃতি। স্ত্রী ছাড়াও হাসানের এ কমিউনিটি পত্রিকার জন্য ১৫ জন নারী ও পুরুষ সাংবাদিক রয়েছেন যারা এ গ্রামেরই বাসিন্দা এবং খেটে খাওয়া মানুষ। কেউ কৃষক, কেউ শ্রমিক, কেউবা দিনমজুর। তারা ঘুরে ঘুরে এ গ্রামের সমস্যার কথা, সম্ভাবনার কথা, মানুষের মনের কথা সংগ্রহ করেন।
হাসান পারভেজ জানান, কোথাও আমার কবিতা ছাপাতে পারিনি। তাই ভাবলাম পত্রিকা বের করলে কবিতাও ছাপাতে পারব এবং মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথাও তুলে ধরতে পারব। যে চিন্তা সেই কাজ। ২০১৯ সালের ১ মে থেকে আন্ধারমানিক পত্রিকা বের হয়েছে, যা এখনো চলমান। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার পশ্চিম সোনাতলায় হাতে লেখে বের হয় আন্ধারমানিক পত্রিকাটি। নিজ হাতে খবর লেখার দুরূহ কাজটি করেন পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক হাসান পারভেজ।
১৯৯৬ সালে এসএসসি পরী¶া দেয়ার কথা থাকলেও অর্থের অভাবে দিতে পারেননি হাসান পারভেজ। পরে ২০১৫ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এসএসসি পরী¶া দিয়ে পাস করেন তিনি। ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি (ভোকেশনাল) পাস করেন তিনি। এখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকও করতে চান হাসান পারভেজ।
হাসান পারভেজ জানান, পত্রিকাটি শুরুতে শুধু পশ্চিম সোনাতলা গ্রামের মানুষকে পড়াতে চেষ্টা করেছি। এখন পাশের আদমপুর, ফতেহপুর, হোসেনপুর, চাঁদপাড়া, নিজকাটা ও টুঙ্গিবাড়িয়া গ্রামের মানুষও আমার হাতে লেখা পত্রিকা পড়েন। আমার সঙ্গে ১৫ জনের মতো লোক কাজ করেন। বলতে পারেন, তারাই আমার সংবাদকর্মী। কেউ কাঠমিস্ত্রি, কেউ দর্জি, কেউ কৃষক, কেউ শ্রমজীবী, কেউ গৃহিণী। গ্রামে তাদের চোখে পড়া ঘটনা আমাকে বলেন। পরে আমি লিখে দিই। তবে তারা কেউ টাকা নেন না।
তিনি আরো জানান, দুই মাস পরপর আমার পত্রিকা বের হয়। প্রতিটি প্রতিবেদন আমি পত্রিকায় নিজের হাতে লিখি। শুধু শিরোনামগুলো কম্পিউটারে কম্পোজ করে দিই। পত্রিকা হাতে লেখার পর আমি মূল কপির ২০০ থেকে ২৫০টি ফটোকপি করি। অর্থ সংকটসহ নানান কারণে কয়েকটি সংখ্যা বের করতে পারিনি। একটি ফটোকপি মেশিন, ছবি তোলার জন্য একটি ক্যামেরা অথবা মোবাইল ফোন ও একটি কম্পিউটার থাকলে কাজটি সহজ হতো। প্রতিটি কপির জন্য খরচ হয় ৭ টাকা। এক সংখ্যা প্রকাশ করতে ১৪০০ থেকে ১৭৫০ টাকা ব্যয় হয়। একেকটি পত্রিকার দাম ১০ টাকা। সব কপি বিক্রি করা গেলে ৫০০ টাকার মতো লাভ থাকে।
তিনি জানান, রুবিনা নামের ৯ বছরের একটি মেয়েকে নিয়ে লিখেছিলাম। তার মা ডলি বেগমকে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা হতো। কারণ তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। পরিবারটি অত্যন্ত দরিদ্র। তাদের দুঃখ-কষ্টের জীবন পত্রিকায় তুলে ধরি। পরে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ওই পরিবারকে একটি ঘর ও দুই শতাংশ জমি দিয়েছে। আমি গ্রামের মানুষের সাফল্যের খবর আমার আন্ধারমানিক পত্রিকায় বেশি প্রকাশ করি।
তিনি আরো জানান, পত্রিকা বের করি মনের আনন্দে। সংসার চলে কাজ করে। বলতে লজ্জা নেই, আমি কখনো ইটভাটায় কাজ করি। কখনো নদীতে মাছ ধরি, কখনো গ্রামের অবস্থাশালী পরিবারের গৃহস্থালির কাজ করি এবং খেতখামারের কাজ করি। যত দিন পারি আমার নিজ হাতে লিখেই পত্রিকা বের করব। তবে পৃষ্ঠা বাড়ানোর ইচ্ছা আছে। এখন আমি নিজ ঘরের বারান্দাকে কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছি। আলাদা একটি অফিস নিতে চাই। সরকার কিংবা সমাজের বিত্তবানরা সহযোগিতা করলে পত্রিকাটি মাসিক করতে পারতেন জানিয়ে হাসান পারভেজ বলেন, ‘তাহলে দেশ ও মানুষের জন্য লেখতে পারতাম।’
আকাশজমিন/এসআর