আকাশজমিন প্রতিবেদক।। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও মঞ্চে আসছে উদীচীর জনপ্রিয় যাত্রাপালা ‘বিয়াল্লিশের বিপ্লব’। ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় নাটক বিভাগের প্রথম যাত্রাপালা ‘বিয়াল্লিশের বিপ্লব’-এর মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মহান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য রচিত এ যাত্রাপালাটি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রখ্যাত যাত্রাশিল্পী ও নির্দেশক, প্রয়াত ভিক্টর দানিয়েল। সহযোগী নির্দেশক হিসেবে রয়েছেন মোফাখখারুল ইসলাম জাপান।
১৯৪২ সাল বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের রক্তক্ষরা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। অগ্নিযুগের অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বাংলার মৃত্যুপাগল যৌবন সেদিন যেভাবে দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছিল, জীবনপণ করে নির্ভীক সৈনিকের মতো আমৃত্যু যুদ্ধ করেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্যে, তাদেরই কিছু কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ এ যাত্রায় চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ যাত্রার চরিত্রগুলোর মধ্যে যেমন জন্মভূমি মায়ের মুক্তি সংগ্রামে নিবেদিত বীরসন্তানরা রয়েছে, তেমনি রয়েছে স্বার্থের মোহে অন্ধ ইংরেজের ক্রীতদাস, রয়েছে ঘরশত্রু বিভীষণের দল। যারা অব্যাহত রেখেছে দেশমায়ের মুক্তিসংগ্রামকে ব্যর্থ করে দেয়ার কূটকৌশল। যাত্রাপালার এক পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের প্রলোভনে মত্ত জমিদার তার স্নেহের নাতি, পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূসহ স্বজনদের হারিয়ে উন্মাদ হয়ে যায়। ইংরেজের বিচারে এই আন্দোলনের মূল নায়ক জমিদারপুত্র মহেন্দ্র (প্রশান্ত) চৌধুরীর দ্বীপান্তর হয়। কিন্তু স্বাধীনতা পাওয়ার পর কালাপানির নির্বাসন থেকে সে আবার ফিরে আসে প্রিয় জন্মভূমির বুকে। দেশজুড়ে যাত্রাশিল্পের যখন ভগ্ন দশা, তখন এরকম একটি কাহিনী নিয়ে উদীচীর শিল্পীকর্মীরা এগিয়ে এসেছে এ শিল্পকে পুনরুদ্ধারে।
উদীচী মনে করে, আবহমানকাল থেকে বিনোদনের প্রধান অনুসঙ্গ ‘যাত্রাশিল্প’ বাঙালি সমাজে একটি বিশেষ ভুমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের এক অতি প্রাচীন গৌরবময় লোকনাট্যধারা এই ‘যাত্রা’। ‘যাত্রা’ আমাদের লোকজ সংস্কৃতির মূল্যবান এবং মৌলিক শিল্পমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ। একাত্তরে মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর সবার প্রত্যাশা ছিল এই শিল্প মাধ্যমটি আমাদের সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে সমাজে একটি নবজাগরণ সৃষ্টি করবে। কিন্তু পঁচাত্তরের দুঃখজনক পট পরিবর্তনের সাথেসাথেই মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় ইতিবাচক অর্জনগুলোর অবক্ষয়ের পাশাপাশি এই লোকজ সাংস্কৃতিক ধারাটিও উল্টোরথে চলতে শুরু করে। সিপাহী সরকারদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ তত্ত্বাবধান, উদ্যোক্তাদের ঘৃণ্য অর্থলোভী মানসিকতা, তথাকথিত প্রিন্সেসদের বেলেল্লাপনা এবং নানাবিধ অশ্লীলতায় এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পমাধ্যমটি ভীষণভাবে কলুষিত হয়ে পড়ে। ফলে, সুস্থ চিন্তার দর্শকরা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন।
‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সমাজের সকল অপসংস্কৃতি বিতাড়ণ করে গণ-মানুষের সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যসহ বাঙালির হাজার বছরের যাবতীয় কল্যাণমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ, লালন, প্রচার এবং প্রসারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যে প্রতিজ্ঞাসমূহ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে সংগঠনের ঘোষণাপত্রে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে সেই মহৎ কর্মকাণ্ডেই নিবেদিত সারা বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বহু দেশজুড়ে উদীচীর অগণিত শিল্পীকর্মী। তাই, যাত্রাশিল্পের এই সংকটকালে এগিয়ে আসা অন্যান্য প্রগতিশীল ঘরানার মতো উদীচীরও পবিত্র দায়িত্ব।
দেশপ্রেম ও বৃটিশবিরোধী বক্তব্য প্রচার করে চারণকবি মুকুন্দদাস শুরু করেছিলেন ‘স্বদেশী যাত্রা’। উদীচীরও এই পরিবেশনা সেই ব্রিটিশ ভারতের স্বদেশী আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য রচিত যাত্রাপালা ‘বিয়াল্লিশের বিপ্লব’। উদীচী মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ বিনির্মাণের লড়াইয়ে পথ চলছে অবিরাম। সে পথচলায় নিশ্চয়ই এটি নতুন মাত্রা সংযোজন করবে। যদি আমাদের স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে বর্তমানের তরুণ বন্ধুরা সমাজের অভ্যন্তরে বিরাজমান স্বার্থপর সাম্রাজ্যবাদী দেশীয় দালাল, মজুতদার, মুনাফালোভী লুটেরাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, তবেই সার্থক হবে বিয়াল্লিশের বিপ্লব, সার্থক হবে উদীচীর এ প্রয়াস।
এবারের যাত্রাপালার মঞ্চায়নের টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ৫০০ এবং ২০০ টাকা। এছাড়া নাট্যকর্মী ও শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকা মূল্যের টিকিট রাখা হয়েছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় উদীচীর স্টল নম্বর: ৮১৫ তে অগ্রিম টিকিট পাওয়া যাবে। এছাড়া শোয়ের দুই ঘণ্টা আগে এক্সপেরিমেন্টাল হলের টিকিট কাউন্টার থেকেও টিকিট সংগ্রহ করা যাবে।
আকাশজমিন/এসএ