ধর্মপ্রবক্তাদের বাইরে, জগতে যত মহাপুরুষদের জীবনী পড়েছি, তাঁদের সৃষ্টিকর্মের সাথে পরিচিত হয়েছি- তাঁরা কেউ বিতর্কের বাইরে ছিলেন না। এটা আদৌ সম্ভবও নয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে- স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, যতজন লেখক তাঁদের সৃষ্টিকর্ম ও ব্যক্তিজীবনের কারণে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন: তাঁদের মধ্যে আল মাহমুদ ও হুমায়ূন আহমেদের নাম আসবে সর্বাগ্রে। আল মাহমুদ বহুমাত্রিক মেধাবী ও যুগের চেয়েও আধুনিক ধ্যান ধারণার সুসাহিত্যিক ছিলেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছিল তাঁর সদর্প-সফল বিচরণ।
তিনি প্রথম জীবনে বামধারার চিন্তাচেতনায় প্রভাবিত ছিলেন, তাঁর লেখাতেও সেই ছাপ স্পষ্ট ছিল। পরবর্তীতে তিনি ইসলামী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হোন। তবে ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে আল মাহমুদের কবি পরিচয়, লেখক পরিচয়টিই প্রধান হয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, যে কারো ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি যদি সেই মতাদর্শের প্রচারক না হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে পলিটিক্যাল এসেট মনে না করে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ মনে করাটাই বেশী যৌক্তিক। তবে দুঃখের বিষয় আল মাহমুদ সম্পর্কে প্রচারণা হল: তিনি ধর্মান্ধ-মৌলবাদী ছিলেন!
অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয়, পাঠকনন্দিত ঔপন্যাসিক। তাঁর কালজয়ী চরিত্র হিমু, মিশির আলী, শুভ্র, আরো বেশ কয়েক দশক ধরে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের মনে রাজত্ব করবে- এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সাধারণ ধর্মবিশ্বাসের বাইরে গিয়ে মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে তিনি বিজ্ঞানমনস্ক মনভাব ব্যক্ত করেছেন। এই নিয়ে একটা অত্যন্ত আপত্তিকর প্রচারণা রয়েছে- হুমায়ূন আহমেদ ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন না।(তিনি নাস্তিক ছিলেন!)
আল মাহমুদ কিংবা হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে, বাস্তবিক বিষয়টি সত্যিকি এমনই ছিল? সেই ফায়সালা কিংবা এই প্রবাদপুরুষ ব্যক্তিদ্বয় সম্পর্কে সাধারণ জনমনে প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাসকে নস্যাৎ করার দায়িত্ব নিয়েছেন এ সময়ের সব্যসাচী সাংস্কৃতিক যোদ্ধা আমিরুল মোমেনীন মানিক। নিঃসন্দেহে এটা বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তবে হাসিমুখে আগুনের জুতো পরিধানকরা ব্যক্তি মানিক সাহেব নির্মোহভাবে, নিরপেক্ষভাবে উপন্যাসের আঙিকে প্রমান করেছেন: আল মাহমুদ ও হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে প্রচারিত বক্তব্যগুলো সত্য নয়: অর্থাৎ আল মাহমুদ ধর্মান্ধ ছিলেন না, কিংবা কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রচারক ছিলেন না।
অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদও ধর্ম অবিশ্বাসী ছিলেন না, বরং ধর্ম সম্পর্কে তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক একটা হাইক্লাস থিংকিং ছিল। পাশাপাশি ধর্মের প্রতি, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি, রাসূল (সাঃ) এর প্রতি হুমায়ূন আহমেদের একটা নরম দিলের ভালবাসা ছিল। যে ভালবাসা থেকে তিনি নবীজি শিরোনামে একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেন।(কিন্তু জীবদ্দশায় উপন্যাসটি তিনি সমাপ্ত করে যেতে পারেননি)।
আমিরুল মোমেনীন মানিক উক্ত মীমাংসায় সার্বিকভাবে কতটা সফল হয়েছেন: তার বিচারের ভার পাঠকদের হাতে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি (হাবিব মোস্তফা) তাকে সফল মনে করি, একই সাথে আমি সম্মানিত বোধ করছি এ কারণে যে, এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে লেখক আমিরুল মোমেনীন মানিক আমার নাম যুক্ত করেছেন বিশেষ এক বিশেষণসহ ‘হাবিব মোস্তফা- নাগরিক সুফি’ উপাধীতে। এটা আমার জন্য বিরল মর্যাদার।
বাংলা সাহিত্যের আকাশে দুই নক্ষত্র ‘আল মাহমুদ ও হুমায়ূন আহমেদ’ সম্পর্কে সকল অপপ্রচার বন্ধ হোক, পাঠক হৃদয়ে সর্বশ্রদ্ধেয় হিসেবে তাঁরা স্থান পাক: কোটি পাঠকের মত আমারও একান্ত চাওয়া- এটাই। লেখক আমিরুল মোমেনীন মানিকের জয় হোক, তাঁর পবিত্র শ্রম সার্থক হোক। ‘আল মাহমুদ ও হুমায়ূন আহমেদের জরুরি বৈঠক’ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে ‘কালো’ প্রকাশনী, ২০২৩ এর বইমেলায় স্টল নম্বর: ১২৩ মুদ্রিত মূল্য রাখা হয়েছে ৩০০ টাকা মাত্র।--লেখক সুফী হাবিব মোস্তফা (গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, লেখক ও গবেষক)
আকাশজমিন/এসএ