পাবনা সংবাদদাতা: পাবনা জেলা পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশ লাইনের ‘নুরজাহান ভবন’ ও ‘সদর পুলিশ ফাঁড়ির মার্কেট’ ভাড়া দেয়ায় স্বজনপ্রীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তৎকালিন পুলিশ সুপার (এসপি) বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
তথ্য মতে, জেলা পুলিশের ওই দু’টি স্থাপনার নেপথ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম নিজেই। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এগুলো বরাদ্দ দিয়েছেন তার ম্যানেজার হিসেবে পরিচিত সাকসেস কর্পোরেশনের স্বত্তাধিকারী হাজী নুরুল আজম তনয় নামের এক ব্যক্তিকে। যিনি তৎকালীন ওই পুলিশ সুপারের নিয়ন্ত্রণাধীন নাজিরগঞ্জ ও রাজবাড়ী অংশের বালি মহাল এবং পাবনা শহরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখভাল করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুলিশ লাইনের সামনে ২৫০০ বর্গফুটের ‘নুরজাহান ভবন’ ১২ বছরের জন্য ভাড়া দেয়া হয়েছে সাকসেস কর্পোরেশনের স্বত্তাধিকারী নুরুল আজম তনয় নামের এক ব্যক্তিকে। ২০০০ সালের পহেলা সেপ্টম্বর থেকে ৩১ আগষ্ট ২০৩২ সাল পর্যন্ত মেয়াদে এই ভাড়ার চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে স্ট্যাম্পে। প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হবে এক লাখ টাকা।
অন্যদিকে একই ব্যক্তিকে পাবনা সদর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ৫২০০ বর্গফুটের একটি মার্কেট ভাড়া দেয়া হয়েছে ৮ বছর মেয়াদে। ৭ ডিসেম্বর ২০২০ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। প্রতি বছর ৩ লাখ টাকা করে ভাড়া দেয়ার চুক্তি করা হয়েছে।
বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, ভাড়া প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সাকসেস কর্পোরেশনের স্বত্ত¡াধিকারী নুরুল আজম তনয় নিজ উদ্যোগে পুলিশ লাইনের সামনে নুরজাহান ভবন ৩১ লাখ টাকা খরচ করে বিল্ডিং নির্মাণ করে নিয়েছেন। সেখানে একটি রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেয়া হয়েছে। অপরদিকে সদর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে বড় বড় ৫টি ঘরের সমন্বয়ে ৪৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা দিয়ে একটি মার্কেট নির্মাণ করে নিয়েছেন। মার্কেটটিতে টাইলসের দোকান ভাড়া দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার ব্যবসায়ী বলেন, জেলা পুলিশের এই সম্পত্তি ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। প্রকাশ্য দরপত্র, পত্রিকায় টেন্ডার বা কোন স্পট কোটেশন আহবান করা হয়নি। গোপনে পছন্দের মানুষকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে এই ভবন ও মার্কেট ভাড়া দিয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ ও অনিয়মের তদন্ত করলেই সব বেরিয়ে আসবে বলে জানান তারা।
অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলামের সাথে। কয়েকবার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপ এ অভিযোগ জানিয়ে তার বক্তব্য চাইলে তিনি সেটি দেখারও পরও কোন মন্তব্য করেননি। ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় অতিরিক্ত ডিআইজির পাবনাস্থ ম্যানেজার হিসেবে পরিচিত সাকসেস কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী নুরুল আজম তনয়ের সাথে। সরাসরি তিনি সাক্ষাত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি নন। তিনি বিষয়টি সংবাদ প্রকাশ না করে এ প্রতিবেদককে ম্যানেজ করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালান।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মাসুদ আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, জেলা পুলিশের এই সম্পত্তি ভাড়া দেয়ায় যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে কিনা এবং এই সম্পত্তি ভাড়া দেয়ায় কি ধরণের বিধান রয়েছে সেটা আমার জানা নেই। তবে নথির আলোকে জেনেছি একটি কমিটি গঠন করে কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ভাড়ার চুক্তি করা হয়েছে।
পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসী বলেন, তৎকালীন পুলিশ সুপার বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম স্যার ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। কমিটির দেয়া প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতেই নুরুল আজম তনয় নামের জনৈক ব্যবসায়ীকে পুলিশের এই সম্পত্তি ভাড়া দেয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই। তবে চুক্তি অনুযায়ী মেয়াদ শেষে দুটি স্থাপনা জেলা পুলিশের সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর সংবাদ ভিত্তিক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের অনুসন্ধান ভিত্তিক অনুষ্ঠান সার্চলাইট এ ‘রেড নোটিশ’ নামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করে। সেখানে উঠে আসে অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলামের ক্ষমতার অপব্যাবহারের ভয়ঙ্কর চিত্র।
প্রতিবেদন সুত্রে জানা যায়, পারিবারিক বিরোধের জেরে স্ত্রী তালাক দেন ইমাদ পরিবহণের মালিক হাবিবুর রহমান হাবিব। তার এক বছর পর হাবিবের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন তার সাবেক স্ত্রী তানজিলা হক উর্মি। এই উর্মির মামা হলেন অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম।
পরবর্তীতে হাবিবকে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত করতে তার নামের সাথে যুক্ত করা হয় খুন, গুম, অর্থ পাচার, জঙ্গী অর্থায়ন, মাদক ব্যবসা, মানব পাচার এবং পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগ। যদিও অভিযোগগুলোর বাস্তবভিত্তিক ও দালিলিক কোনো প্রমাণ ছিল না। ছিল শুধু নারী নির্যাতনের সেই মামলাটি। তারপর হাবিবকে মোস্ট ওয়ান্টেড বানিয়ে রেড নোটিশ জারী করা হয়।
নোটিশ জারীর পরপরই সৌদি আরবে গ্রেপ্তার করা হয় হাবিবকে। তবে নিয়ম বহির্ভূত বুঝতে পেরে নোটিশটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করে বাংলাদেশ পুলিশ। পুরো এই ঘটনার পেছনে রয়েছেন অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম। তবে এখনও সৌদি আরবের কারাগার থেকে মুক্তি মেলেনি হাবিবের। দেড় বছর ধরে বন্দি সেখানে। এরপর থেকেই আলোচনায় অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম।
আকাশজমিন/এসআর