মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩৯ অপরাহ্ন

ভোট নিয়ে কূটনীতি

আকাশজমিন রিপোর্ট:
  • সর্বশেষ আপডেট : মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩ ১:৫৯ am

আকাশজমিন প্রতিবেদক: দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ও অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের আলোকে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে বাংলাদেশ। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে চাপে রাখার প্রবণতা রয়েছে। এজন্য বরাবরই তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ তাদের অগ্রাধিকারের বিষয়ে সোচ্চার থাকেন এবং সরকারবিরোধীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের আর বাকি প্রায় ৯ মাস। এই নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিনিয়তই কূটনৈতিক তৎপরতায় পরিবর্তন ঘটছে।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে স্পষ্টই জানানো হয়েছে, নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা হবে না। নির্বাচন হবে সংবিধান অনুসারে। এই দাবির বাইরে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তাব আমলে নেয়া হবে। সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিদেশি বন্ধুরাও নির্দলীয় সরকার নিয়ে কথা বলছে না। বরং তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের নিশ্চয়তা চাইছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ায় সরকারি দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে চলছে দেনদরবার ও নানা আলোচনা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে চাপে রাখতে কূটনীতিকদের ব্যবহার করছে। প্রকাশ্যে ও গোপন বৈঠকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য কূটনীতিকরাও চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন বৈঠকে খোলামেলা আলোচনায় রাজনীতিকদের মনোভাব জানার চেষ্টা করছেন। দুই দলের নেতাদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আস্থা বাড়াতে গোপন বৈঠকেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

প্রায়ই পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিকরা নির্বাচন কমিশন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যালয় ছাড়াও নিজেদের বাসভবনে বা দূতাবাসে বৈঠকের পর বৈঠক করছেন। এসব দেশের বিশেষ করে মার্কিন সরকারের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। ইইউ ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এজন্য ইউরোপীয় জোটটি বাজেটও বরাদ্দ দিয়েছে।

কযেকদিন আগে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইইউভুক্ত সঙ্গে দেশের কূটনীতিকরা। বৈঠক শেষে বিএনপি জানায়, এই সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে বিদেশি কূটনীতিকদের জানিয়েছেন। অন্যদিকে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক মিশন পাঠাতে প্রস্তুত রয়েছে। তবে সেজন্য বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে।

একই দিন এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ক্ষমতা দখলের জন্য বিএনপি নেতারা বিদেশি দূতাবাসগুলোতে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। বিদেশি প্রভুদের স্বার্থরক্ষার মুচলেকা দিয়ে যারা ক্ষমতায় আসে তারা কখনোই জনগণের কল্যাণ করতে পারে না।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ সব দলের অংশগ্রহণ চায়। তারা বিভিন্ন বৈঠক ও আলোচনায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বার্তাও অব্যাহত রেখেছে। তারা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাছে ঘুরে-ফিরে একটাই আবেদন রাখছে, আগামী নির্বাচন যেন কোনোক্রমেই ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো না হয়। এজন্য তারা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ও জনগণের ভোট দেয়ার পরিবেশের নিশ্চয়তার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকার তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে আশ্বস্তও করেছে। তবে বিএনপি এখনো নির্বাচনে আসার ব্যাপারে কোনো ঘোষণা দেয়নি। নির্দলীয় সরকার ও তাদের দলের প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন-কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে বিশ্ববরেণ্য ৪০ জন ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন; যা গত ৭ মার্চ ওয়াশিংটন পোস্টে বিজ্ঞাপন আকারে ছাপা হয়েছে। এই নতুন বিতর্কেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনের বিষয়ে সন্দেহ করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ চিঠিতে অন্যতম স্বাক্ষরকারী সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ইউনূসের বন্ধুত্ব ও অতীতে ইউনূসের হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করারও রেকর্ড রয়েছে। আর সরকারকে চাপে রাখতে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি ড. ইউনূসের মতো সরকারবিরোধীদের তৎপরতা ও লবিং এখনো জারি রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়াও নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে চাপে রাখার প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। যদিও চলতি বছরের শুরুতে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বিশেষ উপদেষ্টা ডেরেক শোলের সফরের সময় থেকে ঢাকা-ওয়াশিংটন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বরফ গলা শুরু হয়।

এ প্রসঙ্গে গত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণকে তার শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তিনি কখনোই কোনো বিদেশি চাপের কাছে মাথা নত করবেন না। আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থান, নিরাপত্তা ও কৌশলগত নানা কারণ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অ লের আধিপত্যেও গুরুত্বপূর্ণ নাম বাংলাদেশ, যেখানে সব দেশেরই ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিজস্ব কৌশল রয়েছে। তাই বাংলাদেশকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিশ্বের পরাশক্তিগুলো। তাই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ইস্যুতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা চায় না তারা। তবে আগামী সরকার এদেশের জনগণই নির্বাচন করবে।

করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বিশ্বকে অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে ঠেলে দিয়েছে, যার প্রভাব মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশও। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নির্বাচন ঘিরে চাপের মধ্যে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা ও বড় চ্যালেঞ্জ এখন। তা সত্ত্বেও নেপথ্যে থেকে পরীক্ষিত ও ঐতিহাসিক বন্ধু ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক দক্ষতায় সব দেশের সঙ্গে জটিল সমীকরণ সামলে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।

বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে নানা উদ্যোগের পাশাপাশি গত সোমবার শেষ হলো বিজনেস সামিট ২০২৩। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মন্ত্রী ও ব্যবসায়ীরা সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ভূমিকা রেখেছে বলে তারা জানান। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিয়ে তারা উদ্বেগ জানালে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বৈশ্বিক নানা চ্যালেঞ্জ ও অভ্যন্তরীণ সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো দিনে দিনে মজবুত হচ্ছে। ফলে এ অ লই না বিশ্বের সব প্রভাবশালী শক্তিগুলো বাংলাদেশকে পাশে চায়। গণতন্ত্র, নির্বাচন ও রাজনীতি ইস্যুতে আমাদের অবশ্যই ঘাটতি আছে। তবে সেগুলো বিদেশিরা না, এদেশের মানুষকেই ঠিক করতে হবে। বিদেশিদের হস্তক্ষেপে বিভাজন কখনো কমেনি, বেড়েছে। যারা এসব ইস্যুতে কথা বলছে, তাদের দেশের বিশেষ করে আমেরিকার গণতন্ত্রও যথাযথ না। তারা আসলে তাদের স্বার্থ আদায়ে সরকারকে এসব ইস্যুতে চাপে রাখে।

 

আকাশজমিন/এসআর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন
আর্কাইভ
© All rights reserved © Akashjomin

Developer Design Host BD