বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন

সড়কে মৃত্যুর দায় নেয় না কেউ

আকাশজমিন রিপোর্ট:
  • সর্বশেষ আপডেট : সোমবার, ২৭ মার্চ, ২০২৩ ১:৩৮ am

প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। শিরোনাম হয় মৃত্যুর সংখ্যা। সেই সংখ্যা একক থেকে দশক, দশক থেকে কখনো কখনো শতকের ঘরে গিয়ে ঠেকে। কিন্তু এর দায় নিতে চায় না কেউ, চলে একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর খেলা।

গত ১৯ মার্চ সকাল সাড়ে ৬টার দিকে মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে ইমাদ পরিবহনের একটি বাস দুর্ঘটনায় পতিত হয়। চালকসহ মারা যান ২০ যাত্রী। একসঙ্গে এত লোকের প্রাণহানি নতুন করে নিরাপদ সড়কের বিষয়টি সামনে এনেছে।

বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রতিবারই এর পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করা হয়। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কারণ ও বিশ্লেষণ নিয়ে কথা বলা মানে শুধু ‘উপসর্গ’ নিয়ে কথা বলা। কিন্তু ঘটনা ঘটার আগে যাদের বিষয়গুলো দেখার কথা, তাদের কার্যক্রম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন না।

যাত্রী অধিকার ও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, প্রতি মাসে সারা দেশে শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৭০টি থাকে যাত্রীবাহী বাস দুর্ঘটনা। ফলে মৃতের সংখ্যাটাও বেশি হয়।

বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রতিবারই এর পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করা হয়। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব কারণ ও বিশ্লেষণ নিয়ে কথা বলা মানে শুধু ‘উপসর্গ’ নিয়ে কথা বলা। কিন্তু ঘটনা ঘটার আগে যাদের বিষয়গুলো দেখার কথা, তাদের কার্যক্রম নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন না!

যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, গত দুই মাসে সড়কে ১৭৮টি বাস দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত ও ৭৪৪ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৯৯টি বাস দুর্ঘটনায় ৯৭ জন নিহত ও ৩৬৯ জন আহত হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে ৭৯টি বাস দুর্ঘটনায় ৮৫ জন নিহত ও ৩৭৫ জন আহত হয়েছেন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য বলছে, গত দুই মাসে সড়কে ১৭৮টি বাস দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত ও ৭৪৪ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৯৯টি বাস দুর্ঘটনায় ৯৭ জন নিহত ও ৩৬৯ জন আহত হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে ৭৯টি বাস দুর্ঘটনায় ৮৫ জন নিহত ও ৩৭৫ জন আহত হয়েছেন।

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে ছয় হাজার ৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বাস দুর্ঘটনা ছিল এক হাজার ৫০৬টি। এসব দুর্ঘটনায় ৪২৭ জন বাস আরোহী নিহত হয়েছেন।

২০২৩ সাল থেকে দুর্ঘটনার ‘মাসিক পরিসংখ্যান’ প্রকাশ করতে শুরু করেছে দেশের সড়ক পরিবহনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপ¶ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশে ৩০৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বাস দুর্ঘটনা ৭৪টি।

দুর্ঘটনার পর অনুসন্ধানে নানা কারণ বেরিয়ে আসে। চলে নানা বিচার-বিশ্লেষণও। শেষ বিচারে দোষী সাব্যস্ত হন চালক, না হয় মালিক। কিন্তু দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যাদের, তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন কিনা, বিষয়টি সবার নজর এড়িয়ে যায়, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত ১৯ মার্চ ইমাদ পরিবহনের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এর কারণ হিসেবে ‘বাসটির অতিরিক্ত গতি’-কে দায়ী করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মাসুদ আলম বলেন, অতিরিক্ত গতির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণে বাসটি এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়। যদি গতি নিয়ন্ত্রণ করে বাসটি চলত তাহলে ২০ জনের জীবন এভাবে ঝরে যেত না।

গত ১৯ মার্চ ইমাদ পরিবহনের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এর কারণ হিসেবে ‘বাসটির অতিরিক্ত গতি’-কে দায়ী করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মাসুদ আলম বলেন, ‘অতিরিক্ত গতির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণে বাসটি এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায়। যদি গতি নিয়ন্ত্রণ করে বাসটি চলত তাহলে ২০ জনের জীবন এভাবে ঝরে যেত না।’

অন্যদিকে, শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু নাঈম মোফাজ্জেল হক জানান, ইমাদ পরিবহনের বাসটির চালক কোনোরকম বিশ্রাম না নিয়ে বাসটি চালাচ্ছিলেন। দীর্ঘ ৩৩ ঘণ্টা ধরে গাড়ি চালানোর কারণে ক্লান্ত ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গার ৫৫ কিলোমিটার সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্দেশিত আছে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। অথচ দুর্ঘটনার শিকার গাড়িটির গতি ছিল ৯০-৯৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ অতিরিক্ত গতিতে চলছিল ইমাদ পরিবহনের বাসটি

এ প্রসঙ্গে ইমাদ পরিবহনের অপারেশন ম্যানেজার ওয়াহেদুল ইসলাম পলু মিয়া বলেন, আমাদের প্রতিটি বাসে জিপিএস লাগানো আছে। আমাদের যে গাড়িটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে সেটির গতি ছিল ঘণ্টায় ৯০-৯৫ কিলোমিটার। সামনের বাম চাকা ফেটে যাওয়ায় চালক যথাসাধ্য চেষ্টা করেও বাসটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ‘চালকের একটানা গাড়ি চালানো একটা উপসর্গ মাত্র। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে যত ভারি গাড়ি বা বাণিজ্যিক গাড়ি আছে সেই তুলনায় বিআরটিএ চালক তৈরি করতে পারেনি। ১০-১৫ বছর আগে থেকেই মার্কেটে ভারী গাড়ি চালানোর লোক নেই। অথচ বিআরটিএ ভারী গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, আমরা চালক তৈরি করতে পারিনি, আপনারা যেভাবে পারেন যাকে খুশি তাকে দিয়ে গাড়ি চালান। আমরা দেখছি, যে অল্পসংখ্যক ড্রাইভার আছেন তাদের দিয়ে এসব গাড়ি চালানো হচ্ছে। সুতরাং এ দায় রেগুলেটরি অথরিটি হিসেবে বিআরটিএর ঘাড়ে যায়। কারণ, তারা চালক বানাতে পারেনি। তাদের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে ভারী গাড়ির রেজিস্ট্রেশন না দেয়া।’

গ্রিন লাইন পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘কোনো দুর্ঘটনা হলে আমরা সহজ-সরল দৃষ্টিতে যা দেখি, এটা কিন্তু আসল কারণ নয়। পুরো পৃথিবী যে কনভেনশন ফলো করে, পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো যাবে না; হাইকোর্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী সবাই একই কথা বলছেন, যেন পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো না হয়। আমরা সেটা মানছি কি? আধুনিক যুগে আমরা কখনো উপসর্গের দিকে তাকিয়েছি কিনা, পুলিশ কেন এগুলো ধরে না?’

তিনি বলেন, ‘হাইওয়ে পুলিশ তৈরি করা হয়েছে যেন রাস্তাঘাটে অনিরাপদ পরিবেশ তৈরি না হয়। প্রধানমন্ত্রী যে বলেছিলেন চালকরা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাবে না, এটা কি হাইওয়ে পুলিশ বাস্তবায়ন করেছে? এটা যদি তারা বাস্তবায়ন করত, তাহলে চালক-মালিকরা কিন্তু সুযোগসন্ধানী হতেন না।’

এ বিশেষজ্ঞের মতে, ‘একটা ঘটনা ঘটার পর আমরা বিষয়টি জানলাম। তাহলে এগুলো দেখার দায়িত্ব কার ছিল? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও আছে। আমার মনে হয়, এখানে আমূল পরিবর্তন দরকার। সেটি করতে হবে গোড়া থেকে। এখন আমরা যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলছি, এগুলো মাত্র উপসর্গ। উপসর্গের মতো একমাত্র চালকই যাবে জেলখানায় অথবা মালিক। কিন্তু বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশÑ যারা ভুল করছে, যারা দায়িত্ব পালন করছেন না, তারা কিন্তু কখনো গণনাযোগ্য হবেন না।’

আমাদের দেশে চালক সংকট আছে। আর যেসব চালক তৈরি হচ্ছে তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শি¶িত না। তারা শুধু ওস্তাদের দেখানো পথে শিখে এবং চালক হয়ে যায়। ফলে রোড সাইন ও স্পিড লিমিট সম্পর্কে তাদের তেমন ধারণা থাকে না। আবার হঠাৎ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলে সেখানে উপস্থিত বুদ্ধির কিছু বিষয় থাকে। এগুলোও তারা তেমন জানেন না। সব মিলিয়ে আমাদের পরিবহন ব্যবস্থার আপাদমস্তক যে অবস্থা, এগুলো মাথায় নিয়ে কখনোই নিরাপদ সড়ক আশা করা যায় না।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আমরা যতটা জেনেছি, গাড়িটির (দুর্ঘটনায় পতিত ইমাদ পরিবহনের গাড়ি) চলাচলের কোনো অনুমতি ছিল না। বিআরটিএ বন্ধ রেখেছিল। সে¶েত্রে মালিক গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে অন্যায় করেছেন। পত্রিকায় দেখলাম চালক টানা ৩৩ ঘণ্টা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। মালিক চালককে দিয়ে কখনো জোর করে এটি করাবেন না। চালকরা টানা কয়েক দিন গাড়ি চালান, আবার কয়েক দিন বিশ্রাম নেন। তবে, এটিও হওয়া উচিত নয়। চালকদের নিয়মিত বিশ্রামের প্রয়োজন।’

‘আমরা সবসময় মালিক-চালকদের বলে থাকি, সেফটি ফার্স্ট। ইনকাম পরে আগে সেফটির বিষয়টা দেখতে হবে। দেশে চালক কম থাকায় অনেক সময় মালিক ও চালক উভয়েই সুযোগ নিয়ে থাকেন। এটা ঠিক নয়। আমাদের দেশে চালকের সংখ্যা বেশি হলে এ অবস্থা তৈরি হতো না।’

এ প্রসঙ্গে বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ‘ওই দুর্ঘটনার জন্য মালিক-চালক উভয়ই দায়ী। গাড়িটির ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না। গাড়িটির রুট পারমিট আমরা স্থগিত রেখেছিলাম, তারপরও সেটি চালানো হয়েছে। এটা অন্যায়। আমরা এখন গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেব।’

প্রতি মাসেই ৫০ থেকে ৭০টি বাস দুর্ঘটনা ঘটছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, আনফিট গাড়ি কখনই রাস্তায় নামাবেন না। এটা মানা মালিকদের দায়িত্ব। গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা, গাড়ির তেল-মবিল ঠিক আছে কিনা, এসব দেখে গাড়ি চালকদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আবার চালকদেরও দায়িত্ব আছে, এসব বুঝে নিতে হবে। দীর্ঘসময় গাড়ি চালানো যাবে না, বিশ্রাম নিতে হবে। এসব বিষয়ে খেয়াল রাখলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে।’

 

আকাশজমিন/এসআর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন
আর্কাইভ
© All rights reserved © Akashjomin

Developer Design Host BD