আকাশজমিন প্রতিবেদক: জলবায়ুর পরিবর্তন, চাহিদা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বিশ্বব্যাপী চাহিদার তুলনায় নিরাপদ পানির উৎস কমে যাচ্ছে। ফলে পানির সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। একই অবস্থা বাংলাদেশেও। দেশে এখন পর্যন্ত ৫৯ শতাংশ নিরাপদ পানি পাচ্ছে মানুষ। সে হিসাবে দেশের পানীয় জলের ৪১ শতাংশই অনিরাপদ। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন ল¶্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিষয়ে গত জুনে তৈরি করা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্য জানা গেছে। তবে ইউনিসেফের তথ্যমতে, দেশে নিরাপদ পানি পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ। এই অবস্থায় ২২ মার্চ দেশে বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়েছে। এ উপল¶ে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মসূচি গ্রহণ করে। এবারের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘আসুন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি।’ দিবসটি উপল¶ে বাণী দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
জানা গেছে, বাংলাদেশে এখনো পাহাড়ি অ লসহ উপকূলীয় অ লে সুপেয় পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে প্রতিবছর পানির স্তর ২ মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে পানির উৎস দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণও বাড়ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ঠেকাতে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে উন্নত উৎস থেকে খাবার পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয়েছে ৯৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে ৮৫ দশমিক ৭০ শতাংশ টিউবওয়েল এবং ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ সরবরাহ করা হয় পাইপ লাইনের মাধ্যমে। বাকি ১ দশমিক ১০ শতাংশ পানি পাওয়া যায় নিকটবর্তী পুকুর, নদী বা অন্যান্য উৎস থেকে। দেশের মোট খাবার পানির মধ্যে নিরাপদ পানির পরিমাণ মাত্র ৫৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করার বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সরবরাহকৃত পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি। আর্সেনিক সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে দশমিক ০১ মাইক্রোগ্রামের (১০ পিপিবি) বেশি আর্সেনিক থাকলে সেটাকে স্বাস্থ্যঝুঁঁকি হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সবশেষ ২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, ডব্লিউএইচও গাইডলাইন অনুসারে পানির উৎসে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। আর গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানির ¶েত্রে এই হার ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী উৎসে আর্সেনিকের পরিমাণ ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর গৃহস্থালিতে অর্থাৎ টিউবওয়েলে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী দেশের ১ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ আর্সেনিক পানির সংস্পর্শে রয়েছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী এই সংখ্যা ২ কোটি ৭৫ লাখ।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের যেসব জেলা আর্সেনিক ঝুঁকিপূর্ণ তার মধ্যে রয়েছে কুমিল্লা, চাঁদপুর, গোপালগঞ্জ, ফেনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এসব এলাকার ২০ শতাংশ টিউবওয়েলে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গভীর নলকূপেও আর্সেনিকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ বেশকিছু জেলার গভীর নলকূপেও আর্সেনিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম আর্সেনিক ধরা পড়ে ১৯৯৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। তারপর সরকার সারাদেশে টিউবওয়েলে আর্সেনিক শনাক্তকরণ প্রকল্প গ্রহণ করে ২০০৩ সালে।
পানীয় জলে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াও নিরাপদ পানির ঝুঁকি তৈরি করছে। একদিকে আর্সেনিক বাড়ছে, অন্যদিকে লবণাক্ত পানির নতুন নতুন ¶েত্র পাওয়া যাচ্ছে, যা আগামী দিনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে ডিপিএইচই। এতদিন উপকূলের জেলাগুলোয় লবণাক্ততা পাওয়া গেলেও বর্তমান রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলাতেও লবণাক্ত পানি পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এএইচএম খালেকুর রহমান বলেন, দেশে আর্সেনিক কমেনি। আর্সেনিকযুক্ত টিউবওয়েলের সংখ্যা বেড়েছে। তবে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহের জন্য সরকার চেষ্টা করছে। নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গভীর নলকূপেও আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। আবার উপকূলের বাইরেও লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।
প্রতিবছর মানুষ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু পানির উৎস কমছে। পানির ব্যবহার এবং অপব্যবহার দুভাবেই পানির প্রাপ্যতা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। পানির গুরুত্ব মনে করিয়ে দিতে প্রতিবছর ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয়।
বিশ্ব পানি দিবস উপল¶ে জাতিসংঘের মহাসচিবের বাণীতেও পানির সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে। এবারের পানি দিবস দেয়া বাণীতে তিনি বলেন, ‘পানির উৎসের প্রতিটি ফোঁটা দূষণের শিকার হচ্ছে, অতিব্যবহারে অপচয় হচ্ছে। চলতি দশকের শেষদিকে পানির সরবরাহের তুলনায় চাহিদা ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’ জাতিসংঘ মহাসচিব তার বাণীতে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ২৫ জনকে এখন পানির সার্বিক চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে উন্মুক্ত জলপ্রবাহ ও পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে, নতুবা উচ্চমূল্যে তথাকথিত নিরাপদ পানি কিনে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (গ্রাউন্ড ওয়াটার হাইড্রোলজি) ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, পৃথিবীতে যত পানি আছে তার ১ ভাগেরও কম পানি আমরা ব্যবহার করতে পারি। বর্তমানে সারা পৃথিবিতে যে পরিমাণ পানি ব্যবহারের জন্য রয়েছে, তার থেকে চাহিদা অনেক বেশি। তিনি বলেন, আমরা যত পানি ব্যবহার করি তার ৮০ ভাগ কৃষি বা চাষাবাদে ব্যবহার করা হয়। আর ১০ ভাগ পানি শিল্পে ব্যবহার করি। গৃহস্থালিতে ব্যবহার করা হয় মাত্র ৫ ভাগ পানি।
ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শফিকুল আলম গত সোমবার পানি দিবসের এক আলোচনায় বলেন, জাতিসংঘ টেকসই ল¶্যমাত্রা অর্জনে ১৫ বছর সময় দিয়েছিল। এরই মধ্যে ৭ বছর চলে গেছে। বাকি আছে ৭ বছর। তাই সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে কাজের গতি বাড়াতে হবে। পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশে পানির সরবরাহ ৯৮ দশমিক ৫ ভাগ। কিন্তু নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনায় মাত্র ৩২ দশমিক ৬ ভাগ অর্জিত হয়েছে। এই খাতে শতভাগ অর্জন করতে হবে। আর স্যানিটেশনে ৩৯ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।
পানির গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২২ মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস ঘোষণা করে। সেই থেকে দিবসটি সারাবিশ্বে পালিত হয়। বাংলাদেশেও বিশ্ব পানি দিবস উপল¶ে সভা-সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।
আকাশজমিন/এসআর