আকাশজমিন প্রতিবেদক: ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে মুক্তিলাভের পর সত্তরের প্রথম দিকে ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশালে রাজনৈতিক সফরে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তখন বিএম কলেজ ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আমিও ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে স্টিমার ঘাট থেকে মিছিলসহকারে অভ্যর্থনা জানিয়ে বরিশাল শহরের চকবাজার, বাজার রোড, ভাটিখানা, সদর রোড হয়ে সার্কিট হাউসে যাই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ পথ অতিক্রম করতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানায়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদের বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ (যিনি পিস্তল মহিউদ্দিন নামে পরিচিত) ছিলেন বৃহত্তর বরিশাল জেলার তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। রাজনীতিকের পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। তিনি বরিশাল বিএম কলেজের সামনে ‘৬৮-৬৯’ সালে একটি আকর্ষণীয় বাড়ি নির্মাণ করেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুন বাড়িতে প্রথম উঠবেন বলে সংকল্প ছিল তাঁর।
কিন্তু তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনি সফরে বরিশাল আসেন। বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা মহিউদ্দিন আহমেদের নতুন বাড়িতে ওঠেন। বঙ্গবন্ধু এক রাত এ বাড়িতে থাকবেন সেজন্য মহিউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর জন্য লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি ও স্যান্ডেল কিনে আনেন। বঙ্গবন্ধুকে মহিউদ্দিন আহমেদ কতটা আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন এটাই তার প্রমাণ। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর সম্মানে বৃহত্তর বরিশাল জেলার প্রায় হাজার দুয়েক লোককে মহিউদ্দিন আহমেদ দাওয়াত করেন। বিএম কলেজ ছাত্রনেতাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এই অনুষ্ঠানটি সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার। আর এই টিমের দলনেতা ছিলাম আমি।
পরদিন বিকেলে বরিশাল সার্কিট হাউস থেকে ঠিকাদার কা ন মিয়ার (মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন) লাল রঙের খোলা জিপে চেপে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বের হলেন। তৎকালীন ছাত্রনেতা হিসেবে আমিও অন্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলাম। তবে আমরা কেউই জানতাম না বঙ্গবন্ধু কোথায় যাচ্ছেন।
সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ধৈর্য ধরো, আমাকে অনুসরণ করো।’ আবার বঙ্গবন্ধুর কাছে আরেকজনের একই প্রশ্ন, ‘কোথায় যাবেন, নেতা?’ তিনি বললেন, ‘আমার বোনের বাসায়।’ আবার প্রশ্ন, কোথায়? ‘এবার তিনি বললেন, সময় হলেই দেখতে পাবে, চলো।’ সফরসঙ্গীদের উৎসাহের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে বঙ্গবন্ধু নিজেই আবার বললেন, ‘টেপা মিয়ার বাসায় যাচ্ছি।’ অতঃপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী হয়ে অন্যদের সঙ্গে আমিও উপস্থিত হই টেপা মিয়ার বাড়িতে।
কে এই ‘টেপা মিয়া’? টেপা মিয়া হলো বরিশালের তৎকালীন একজন প্রথিতযশা আইনজীবী ও বামপন্থি রাজনৈতিক নেতা শ্রদ্ধেয় আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, যিনি সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর পিতা। সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি এবং যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শহিদ শেখ ফজলুল হক মনির শ্বশুর। বঙ্গবন্ধু তাকে ‘টেপা মিয়া’ নামে ডাকতেন। উল্লেখ্য, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত আমাদের পারিবারিক আইনজীবী ছিলেন বিধায় তার সঙ্গে আমারও সুসম্পর্ক ছিল।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাকে অনেক আদর করতেন। তিনি বরিশালের আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। আত্মীয়তার বাঁধনের কারণেই পরবর্তীতে তিনি ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে থাকেন। তিনি এমএনএ হন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে একজন পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক নেতার সুখ্যাতি অর্জন করেন।
বঙ্গবন্ধু বরিশাল সার্কিট হাউসে অবস্থানকালে আমরা বিএম কলেজ ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমি, কামাল আফরোজ, এনায়েত হোসেন চৌধুরী, আজাদ হামিদ চৌধুরী, জাহিদ হোসেন চৌধুরী, বাহাউদ্দিন, মুসফিকুর রহমান, মন্টু, সুরুজ, খান আলতাফ হোসেন ভুলু, ছবিরসহ অনেকে তাঁর বেড রুমেই সাক্ষাতের অনুমতি পাই। তিনি আমাদের অনেক সময় দেন, ধৈর্যসহকারে আমাদের কথা শোনেন, আমাদের অনেক দিকনির্দেশনা দেন। সেদিন আমি বুঝতে পারি, বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ছাত্রলীগের অবস্থান কতটা গভীরে। তাঁর সেই অনুপ্রেরণা আজও আমার রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক। অনেক কথার মাঝে তিনি আমাদের একটি কথা বললেন, ‘আগামীতে আবার যখন আসব তখন তোমাদের জাদু দেখাব।’ আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চাইলাম, ‘কী জাদু দেখাবেন নেতা?’
তিনি বললেন, ‘এখন বলে দিলে তো জাদুর আকর্ষণ থাকবে না, সময় হলে দেখাব।’ এর বেশ কিছুদিন পর ১৯৭০ সালের শীত মৌসুমে বঙ্গবন্ধু পুনরায় বরিশাল অ লে সফরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের সাবেক ভিপি শওকত আলম ছগির ভাইয়ের আমন্ত্রণে ১০ এপ্রিল বিকেলে মঠবাড়ীয়া আসেন এবং জনসভায় বক্তব্য দেন। পরদিন ১১ এপ্রিল পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় জনসভা করেন সকাল ১০টায়। বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে ল যোগে মঠবাড়ীয়ার তুষখালীতে আসেন। বরিশাল থেকে ল যোগে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মালেক, নুরুল ইসলাম মঞ্জুু, আমির হোসেন আমু, মহিউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট হুমায়ুন আহমেদ, অ্যাডভোকেট সামসুল হক, হেমায়েত উদ্দিন, সরদার জালাল, আক্কাস ভাই এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ আমরা কয়েকজন ছাত্রনেতাÑ অর্থাৎ আমি, কামাল আফরোজ, এনায়েত চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, খান আলতাফ হোসেন ভুলু, মুসফিকুর রহমান, ছবির, মন্টুসহ কয়েকজন সফরসঙ্গী হই।
সকাল সাড়ে আটটায় আমরা তুষখালী পৌঁছাই। তখন কুশায়াচ্ছন্ন ছিল। দুই ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ল তুষখালী আসে। বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের নেতা তোফায়েল আহমেদ, বর্তমান জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশীদসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃবৃন্দ ল থেকে নেমে আসলেন কিন্তু উৎসুক জনতার দৃষ্টি লে র দিকে। এর কারণ আমাদের জানা ছিল না। হয়তো ওখানে এমন কোনো ব্যক্তির নাম প্রচার করা হয়েছে তিনি লে ই আছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাশাপাশি হাঁটছিলাম কিন্তু লোকজন তখনও লে র দিকে তাকিয়ে।
এমন সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘লে র ভিতরে জাদু আছে, নামিয়ে আনো।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে, নেতা?’ বঙ্গবন্ধু হাসিমাখা মুখে বললেন, ‘ফায়জুল হক’ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ছেলে। আমি লে গিয়ে দেখি ফায়জুল হক সাহেব শেভ করছিলেন। তাকে উপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু আমাকে পাঠিয়েছেন বলায় তিনি ত্বরিৎ তৈরি হয়ে নামলেন। উৎসুক জনতাও তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছেন। বঙ্গবন্ধু রিকশায় এবং আমরা হেঁটে তুষখালী থেকে মঠবাড়ীয়া পৌঁছালাম। আমার ধারণা হলো, এ অ লের সবচেয়ে প্রিয় নেতা শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু তার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসছেন।
মঠবাড়ীয়ার জনসভা মে বঙ্গবন্ধু আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে বাম নেতা ও তার ভগ্নিপতি হিসেবে জনতার সামনে পরিচয় করিয়ে দেন। তখনও তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেননি। একই সময়ে বঙ্গবন্ধুর সেই জাদুর লোক শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ছেলে ফায়জুল হককেও পরিচয় করিয়ে দেন। ছগির ভাইয়ের গ্রামের বাড়ি শহর থেকে কিছুটা দূরে। ঐ দিন আমরা রাতের খাবার খাই ছগির ভাইয়ের বাড়িতে। পরদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ল যোগে মঠবাড়ীয়া থেকে ভান্ডারিয়া, কাউখালী, হুলারহাট হয়ে পিরোজপুরে আসি। এ সময় লে বঙ্গবন্ধু তার রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে নেতাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন। কাউখালী থেকে হুলারহাট লে প্রায় ৩০ মিনিটের পথ।
বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন লে বসে নদীর পানিতেই গোসল করবেন। কারণ নদীর পানি ছিল একদম টলটলে। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে ইঙ্গিত করে তোফায়েল ভাইকে বললেন, ‘এদেরকে নিয়ে যাও, আমি গোসল করবো।’ তখন আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘আপনার গোসলের পানি আমি নদী থেকে তুলে দেই’ নেতা। বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন, সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধু কামাল আফরোজও থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে বঙ্গবন্ধু রাজি হন। নদী থেকে আমরা পানি তুলে দেই এবং নিজ হাতে সাবান গায়ে মাখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করিয়ে দেই। তখন বঙ্গবন্ধুকে আমি আমার বাড়িতে অতিথি হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। তিনিও সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এই স্মৃতি আমার আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আমার চাচা ইসরাইল মোল্লা কলকাতা পড়াশোনা করার সময় সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে সুসম্পর্ক হয়। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। আমার চাচা ইসরাইল মোল্লা ও অ্যাডভোকেট রশিদ মিয়ার সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক ছিল। তারা উভয়ই ইসলামিয়া কলেজে পড়াশোনা করতেন এবং বেকার হোস্টেলে থাকতেন। আমার এলাকায় যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করার সুবাদে ’৭০-এর নির্বাচনের পূর্বে ১৮ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার নিজ গ্রাম বাউফলের কালাইয়া গার্লস স্কুলসংলগ্ন ধান হাট মাঠে বিকেলে একটি জনসভা করেন। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন এম.এ গফুর মিয়া।
তখন বিএম কলেজের ছাত্রনেতা হিসেবে ঐ সভা পরিচালনার দায়িত্ব ছিল আমার। সভা শেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর সফরসঙ্গী বরিশাল ও পটুয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আমার মা-চাচিদের হাতে তৈরি উন্নত মানের পিঠা ও খাবার দ্বারা তাকে আপ্যায়িত করা হয়। এ সময় এই অ লের নেতৃবৃন্দ সাংগঠনিক অবস্থান ও তাদের মনোনয়নের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর নিকট আবদার করেন। বঙ্গবন্ধু নীরবে সবার কথা মনোযোগসহকারে শুনতে থাকেন।
আমাকে বললেন, ‘ফিরোজ, আমাকে এক কাপ চা দাও।’ চা খেতে খেতে তিনি বললেন, ‘তোমাদের সকলের কথা আমি শুনলাম, এবার তোমরা আমার কথা শোনোÑ শাড়ি-লুঙ্গি নতুনটা ভালো, কিন্তু বন্ধু ভালো পুরানটা।’ এখন তোমরা যা বোঝার বুঝে নাও। আমাদের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুকে আপ্যায়নের সুযোগ পেয়ে আমি ও আমার পরিবার ধন্য হয়েছি। আমি জানতাম, বঙ্গবন্ধু কৈ মাছ পছন্দ করেন। তাই ভোলা থেকে বড় আকারের কৈ মাছ এনেছিলাম তাঁর জন্য। এ সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে জনকল্যাণে কাজ করার উপদেশ দেন। এছাড়াও পটুয়াখালীর জুবলী স্কুলমাঠে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনি জনসভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। এর চার মাস পরে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর ২১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু বিধ্বস্ত দক্ষিণা ল বিশেষ করে ভোলার বোরহান উদ্দিন, লালমোহন এবং পটুয়াখালীর বাউফল ও গলাচিপা সফর করেন।
সফরকালে বঙ্গবন্ধু পুনরায় আমার গ্রামের বাড়ি কালাইয়া আসেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু যে ঘরে বসে মাত্র চার মাস আগে খাওয়া-দাওয়া করেছেন সে ঘরটি ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তখন বঙ্গবন্ধু আমার চাচা ইসরাইল মোল্লাকে সান্ত্বনা দিয়ে সমবেদনা জানান এবং এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করেন এবং তিনি আমাকে ঢাকা এসে দেখা করতে বলেন। আমি তখন বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি। দুস্থ, ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা বিপদগ্রস্তকে আপন করে নেয়ার অসীম ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর মাঝে দেখে আমি মুগ্ধ হই। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জনগণের প্রকৃত বন্ধু। তাই তিনি হয়েছেন বঙ্গবন্ধু, হয়েছেন জাতির পিতা।
পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বন্যার্তদের মাঝে রেড ক্রিসেন্ট এবং আওয়ামী লীগের ত্রাণসামগ্রী নিয়ে রেড ক্রিসেন্টের প্রতিনিধি, বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ও আমার চাচা অ্যাডভোকেট আব্দুর রশীদের নেতৃত্বে দক্ষিণা লের চরা লে ত্রাণ বিতরণে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সময় চর বিশ্বাস, চর কাজল, বড় বাইশদা, ছোট বাইশদা, রাঙাবালিসহ বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণসামগ্রী (থালা, বাসন, কম্বল, পরিধেয় বস্ত্র, থাকার জন্য তাঁবু) ইত্যাদি নিয়ে দুইটি ল যোগে বন্যাকবলিত এলাকায় যাই। সেখান থেকে আমি দুস্থের সেবা করার প্রেরণা পাই। এখানে উল্লেখ্য, বরিশালের সঙ্গে তৎকালীন সময়ে পটুয়াখালীর সড়ক ও নৌপথে যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো না থাকায় পটুয়াখালীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ কম ছিল।
যার কারণে বরিশালের রাজনীতির সঙ্গে আমি বেশি সম্পৃক্ত ছিলাম। আমি ঢাকা এসে দেখা করি, আমার প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু আমাকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বইপুস্তক ও জামা কাপড় কেনার জন্য ২০০ টাকা দিলেন। যা দিয়ে আমি মুজিব কোট, পায়জামা-পাঞ্জাবি ও স্যান্ডেল ক্রয় করি। এর পরও আমার নিকট ৩০ টাকা ছিল।
’৭০-সালে বরিশাল বিএম কলেজসহ বরিশালের বিভিন্ন কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন ছাত্রলীগ বরিশালে দুই গ্রুপে বিভক্ত ছিল। এক গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলাম আমি এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন খান আলতাফ হোসেন ভুলু। নির্বাচনে আমি বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপিসহ পূর্ণ প্যানেল এবং অন্যান্য কলেজ যেমনÑ মেডিকেল কলেজ, নাইট কলেজ, হাতেম আলী কলেজ, ল’ কলেজ ও টেকনিক্যাল কলেজে আমার সমর্থিত প্যানেল জয়লাভ করে। নির্বাচিত হওয়ার পর আমি সব কলেজের নির্বাচিত ভিপি-জিএসদের নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করতে আসি। তিনি উপর থেকে নিচে এসে আমাদের পরিচয় নিলেন।
বঙ্গবন্ধু নারিকেল, মুড়ি, গুঁড় দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করান। আমরা বরিশালের ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা করি এবং বরিশালে ছাত্রলীগের কমিটিতে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার অনুরোধ জানাই। ’৭০-এর নির্বাচনে আমি একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে নৌকার পক্ষে কাজ করি। ’৭০-এর বন্যার পরে বরিশাল বিভাগের নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। পরে নির্বাচন হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদের সরকার গঠন করতে দিলো না, তখন আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের ভাষণে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করার পর থেকে এক মাস বরিশাল মুক্ত ছিল। এ সময়ে আমরা দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমি ছিলাম মলোটব ককটেল বানানোর দায়িত্বে। বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীতে রসায়নের শিক্ষক শামসুদ্দিন খান সাহেবের তত্ত্বাবধানে আমরা এগুলো বানাতাম। তিনি ছিলেন বর্তমান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত মেজর নুরউদ্দিন খান ও কর্নেল কুতুব উদ্দিন খানের বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতা। ২৫ এপ্রিল যখন পাকবাহিনী বরিশাল আসে তখন আমরা বরিশাল ত্যাগ করি। বরিশাল থেকে এসে একদিন স্বরূপকাঠী থাকি এবং ২৭ এপ্রিল ভোরে ২টি ল সহ আমরা ভারতের উদ্দেশে রওনা করি এবং ৩০ এপ্রিল ভারতে পৌঁছি।
ভারতে সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ২টি ল যোগে বরিশালে আসার পথে ৬ মে খুলনার গাবুরা নামক এলাকায় পাকবাহিনীর গানবোট দ্বারা অতর্কিত হামলার শিকার হই। এই হামলায় ৪৭ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে এম এন এ নুরুল ইসলাম মঞ্জু ও মেজর জলিলের নেতৃত্বে কিছু লোক ভারতে চলে যেতে সক্ষম হলেও আমিসহ ১৯ মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে আটক হই। আটককৃতদের মধ্যে তৎকালীন সংসদ-সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমেদও ছিলেন। দু’দিন আটক থাকার পর পাকিস্তান আর্মির গানবোট আসে এবং পরবর্তীতে আমাদের ১৯ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি ও আমার বন্ধু ফুটবলার সুরুজ বোট থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষা করি।
এ সময় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির লোকজনের হাতে ধরা পড়ি। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রশিদের পরামর্শে সুকৌশলে পালিয়ে এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় নেই, তখন প্রায় মাগরিবের সময়। তাদের আমি বলি, আমি নৌকার লোক, আমি বঙ্গবন্ধুর লোক, এ কথা শুনে তারা আমাকে তাদের পাট রাখার গুদামে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করে।
এ সময় বাইরে গানবোটের মাইকে আমাদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। এই ভয়ে আমাকে ঘরের পাশেই একটি বড় গাব গাছে উঠিয়ে দেয়। আমি এতই দুর্বল ছিলাম যার কারণে বিবস্ত্র হয়ে পরনের গামছা দিয়ে গাছের সঙ্গে নিজের শরীরকে বেঁধে রেখেছিলাম, যাতে পড়ে না যাই। এরপর রাত আনুমানিক ৮টার দিকে ওই বাড়ির লোকজন আমাকে গাছ থেকে নামিয়ে আনেন এবং এক খ্রিস্টান বাড়িতে রেখে আসেন। রশিদের মা ওই বাড়িতে আমার জন্য খাবার পৌঁছে দিতেন। পরের দিন রশিদের মা তার নাকের মিনা এবং একটি পিতলের কলস বিক্রি করে আমাকে কিছু টাকা দেন।
সেই টাকা নিয়ে ১০ মে মংলায় রশিদের সহযোগিতায় একটি কাঠবোঝাই নৌকায় রাত্রি যাপন করি। ১১ ও ১২ মে খুলনায় আমার মামাতো ভাই মালেক সাহেবের বাসায় থাকি। ১৩ মে রূপসা-বাগেরহাট-পিরোজপুর-হুলারহাট হয়ে স্বরূপকাঠী এসে কোনো আপনজনের বাড়িতে আশ্রয় না পেয়ে নৌকায় রাত্রি যাপন করি। সেখানে মামাতো ভাই বাসুর সঙ্গে দেখা হয় এবং তাদের বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করি। কিন্তু রাতে থাকার কথা বললে তারা অস্বীকৃতি জানায়। ১৪ মে আমার চাচা ইসরাইল মোল্লার শ্বশুরবাড়ি ভারুকাঠী মিয়া বাড়িতে ৪ দিন ছিলাম। ১৮ মে গুটিয়া এলাকায় গোলাগুলি হলে বিকেলে আগরপুরের উদ্দেশে রওনা দেই। সন্ধ্যা হয়ে গেলে পথিমধ্যে গুটিয়া হাই স্কুলের দপ্তরির সঙ্গে অভুক্ত রাত্রি যাপন করি। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের এক আত্মীয় আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করেননি। আমি ভয়ে ছিলাম তিনি যদি আমাকে ধরিয়ে দেন।
১৯ মে আমার মামার শ্বশুরবাড়ি আগরপুর মিয়া বাড়িতে পৌঁছাই। সেখানে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করি। তিনিও আমাকে দেখে বিব্রত বোধ করেন। পরবর্তীতে আমার মেজ ভাইয়ের (মুক্তিযোদ্ধা এবিএম রেজা) শ্বশুরবাড়ি গৌরনদীর কান্ডপাশা গ্রামে ৮ দিন অবস্থান করার পর ২৭ মে ভারতের উদ্দেশে রওনা দিয়ে ফিরোজ খানের সঙ্গে গৌরনদী-পয়সারহাট, গোপালগঞ্জের ওরাকান্দি হয়ে ৩০ মে ভারতের বেনাপোল পৌঁছাই। সেখান থেকে পশ্চিম বঙ্গের হোসনাবাদের টাকি ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছি। তার দু’দিন পরেই সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচে ট্রেনিং শুরু হয়। বন্ধুবর কামাল ছিল সেই ব্যাচে। সেই ব্যাচে আমাকেও মেজর জলিল মনোনয়ন দিলে রাজনৈতিক নেতার নির্দেশনায় আমাকে ট্রেনিংয়ে না নিয়ে টাকি, আমলানি, পিপা, থুবা এবং আরো কয়েকটি ক্যাম্পে গিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ৯নং সেক্টরের চিফ পলিটিক্যাল মোটিভেটরের দায়িত্ব প্রদান করেন। এ সময় আমি বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ এবং কাদের বিরুদ্ধে ও কেন এই যুদ্ধ এসব বিষয়ে মোটিভেশনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করি। পরবর্তীকালে সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন অ লে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেই এবং গানবোটে এন্ট্রি এয়ারক্রাফ্ট গানের দায়িত্ব পালন করি।
২০ নভেম্বর ঈদের দিন কালিগঞ্জ থানার পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে আমি এবং বর্তমান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন, পাকবাহিনীর ২ সদস্য ও আমি এককভাবে ১২ রাজাকারকে আটক করে এলাকা শত্রুমুক্ত করি। পাকিস্তান আর্মির এক সেনাকে আটক করে নিয়ে আসলে তিনি উর্দুতে ‘হামারা কই কছুর নেহি, মাই কমান্ডার কমান্ড কিয়া, মাই কমান্ড ফলো কিয়া ও ছালা ভাগ গিয়া, মুজে মাফ করদো।’ বলে তিনি পকেট থেকে একটি ছবি বের করে বলে ‘এ মেরে তজবির হায়, এ মেরে বাল বাচ্চা হায়, হামারা কই কছুর নেহি।’
এ ঘটনায় খুশি হয়ে মেজর জলিল আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ১ হাজার টাকা বকশিশ প্রদান করেন। এই যুদ্ধে মেজর হুদা, ক্যাপ্টেন বেগ, লে. সচিন কর্মকার, লে. আহসান ও লে. মাইনুল, ডা. শাহজাহানসহ কয়েক মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, এদিন ঈদের দিন ছিল কিন্তু দুঃখের বিষয় ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পাইনি। এভাবে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আমরা স্বাধীন দেশ, লাল সবুজের পতাকা অর্জন করি। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার দুদিন পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। এই মাহেন্দ্রক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে আমি ছিলাম পাগলপ্রায়, উদগ্রীব। বরিশালের ছাত্রনেতাদের একটি গ্রুপ নিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে যথারীতি স্টিমারযোগে জিপগাড়িসহ ঢাকা আসি এবং তেজগাঁও বিমানবন্দরে উপস্থিত হই।
বিমান থেকে সিঁড়ি বেয়ে বঙ্গবন্ধু নিচে নেমে এলে আমি তাকে সালাম করি। আমাকে সামনে দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুই কি বেঁচে আছিস?’ পরক্ষণেই তিনি আমার চাচা ইসরাইল মোল্লা কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলেন। এ ছিল আমার জীবনের পরম পাওয়া। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিমানবন্দর থেকে নেমে হেঁটে গাড়িতে ওঠার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকার। বঙ্গবন্ধু আমার কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটছিলেন। বিমানবন্দর থেকে যে ট্রাকটিতে করে বঙ্গবন্ধু আসেন সেই ট্রাকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সহযাত্রী ছিলাম, যা আমার জীবনের চরম সৌভাগ্যের। এ সময় ট্রাকে আরো যাঁরা ছিলেন ছাত্র ও যুবনেতা মনি ভাই, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শেখ কামালসহ অনেক নেতাকর্মী। ঐ ট্রাকে যেসব নেতৃবৃন্দ ছিলেন তাঁদের অনেকেই বেঁচে নেই। যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের মধ্যে আমি, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী অন্যতম। কেবল তোফায়েল আহমেদ এবং আমি বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে আছি।
জনসমুদ্র কী রকম হতে পারে সেটা দেখেছি সেদিন। বিমানবন্দর থেকে পুরো রাস্তা লোকে লোকারণ্য। গাছের উপরে, ছাদের উপরে সবখানেই মানুষে ঠাসা। মানুষের ভিড় ঠেলে মিডিয়া কর্মীদের বহনকারী গাড়িটি যথাসময়ে সামনে আসতে না পারায় ঐ সংবাদ কভার করতে যাওয়া ফটো সাংবাদিকরা ছবি তুলতে পারেননি। যে কারণে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের অধিকসংখ্যক ছবি পাওয়া যায়নি। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার রাস্তা যেতে সময় লেগেছিল দুই ঘণ্টারও বেশি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল রেসকোর্স ময়দানে ’৭০-সালের জাতীয় নির্বাচনের পর ৩ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে নির্বাচিত বরিশাল বিভাগের এমপি ও এমএনএদের সঙ্গে শপথ অনুষ্ঠান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এবং ’৭২-সালের ছাত্রলীগের সম্মেলনে উপস্থিত থাকার।
এছাড়াও ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গভবনে তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যত বারই ঢাকায় এসেছি ততবারই হয় তার অফিসে, না হয় তাঁর বাসায় দেখা করেছি। বরিশাল বিএম কলেজে পাঁচটি বিষয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স খোলার জন্য আমার নেতৃত্বে বিএম কলেজের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩২ নম্বরে সাক্ষাৎ করলে বঙ্গবন্ধু আমাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে বলেন এবং তখন তার সঙ্গে দেখা করি।
বঙ্গবন্ধু তখন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীকে নির্দেশ প্রদান করেন, যার ফলে বিএম কলেজে পাঁচটি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু হয়।
১৯৭৫ সালের ২৩ মার্চ আমি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। নববধূ দেলোয়ারা সুলতানাকে সঙ্গে নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদ গ্রহণ করি। তিনি আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবন কামনা করে আশীর্বাদ করেন। পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। আমরা ৮ ভাই’র সবাই ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। কেউ ভিপি, কেউ জিএস, কেউ সাইন্স অ্যাসোসিয়েশনের ভিপি ছিলেন। আমিসহ আমার ৪ ভাই মুক্তিযোদ্ধা।
আকাশজমিন/এসআর