আকাশজমিন প্রতিবেদক: বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া। যিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ রাজধানী ঢাকা আক্রান্ত হওয়া এবং বাঙালি পুলিশ সদস্যদের প্রতিরোধের বার্তা বেতার মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এজন্য পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে চরম নির্যাতনও ভোগ করতে হয়েছিল তাকে।
পরে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন এলাকায় বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব কষ্ট ভুলে গেলেও একটি আ¶েপ রয়েছে তার। বিভিন্ন স্থান থেকে সম্মাননা পেলেও এ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোনো খেতাব তিনি পাননি।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’-এর সামনে সম্প্রতি কথা হয় সাহসী এই মুক্তিযোদ্ধা সাবেক বেতার অপারেটর শাহজাহান মিয়ার সঙ্গে। বিজয়ের গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনসহ রাজধানীর বিভিন্নস্থানে হামলা চালায়, তখন তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিলম্ব না করে তিনি এ বর্বর হামলার খবর সারাদেশে বেতার বার্তার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
শাহজাহান মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাত্র এক বছর আগে তিনি কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। প্রশি¶ণ শেষে তাকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বেতার অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালায়, তখনই তিনি দ্রুত এ সংবাদ বেতারের মাধ্যমে সারাদেশের পুলিশ স্টেশনগুলোতে জানিয়ে দেন। এজন্য কয়েক ঘণ্টা পর ২৬ মার্চ ভোর পাঁচটার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাকে আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন।
তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে পুরো পূর্ব পাকিস্তানের সব বিভাগ ও জেলা শহরের পুলিশ স্টেশনগুলোতে তিনি একটি মেসেজ পাঠান। সেই মেসেজটা ছিল- ‘বেজ ফর অল স্টেশন্স অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসেন অ্যান্ড ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেল্ভস, ওভার।’
শাহজাহান মিয়া বলেন, ২৮ মার্চ বিকাল ৩টার দিকে তাকে পাকিস্তানি বাহিনী ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে ২৯ মার্চ মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনে যান। সেখানে যাওয়ার পথে সূত্রাপুর লোহার ব্রিজের পাশের খালে নারী-পুরুষসহ অসংখ্য মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহিদ হওয়া এসব মানুষের অনেকের লাশই তখন পচে ফুলে উঠেছিল।
পুলিশ বাহিনীর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া বলেন, মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনে গেলেও সেখানকার পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তারা তার নিরাপত্তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। ফলে পরদিন ৩০ মার্চ বন্ধু কনস্টেবল শেখ আশেক আলীসহ গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার উদ্দেশে তিনি বের হয়ে পড়েন। হেঁটে নেত্রকোনা পৌঁছাতে তাদের সময় লেগেছিল চারদিন।
বাড়িতে গিয়ে নিজের চিকিৎসা করেন শাহজাহান মিয়া। পাঁচ-ছয়দিন বাড়িতে থেকে পরে ছোট ভাই নুরুল ইসলাম নুরুসহ ভারতে চলে যান। ভারতে গিয়ে কয়েক সপ্তাহ প্রশি¶ণ নিয়ে আবার দেশে এসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এ সেক্টরের অধীন ধর্মপাশা, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও হালুয়াঘাট এলাকায় অসংখ্য সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।
মিত্র বাহিনীর মেজর পীরিতের নেতৃত্বে ৬ ডিসেম্বর দুর্গাপুর থানার বিজয়পুর বিওপি আক্রমণের সময় মাইন বিস্ফোরণে তিনি গুরুতর আহত হন। তার ছোট ভাই নুরুর মুখমণ্ডল সম্পূর্ণ ঝলসে যায়। সহযোদ্ধা ওসমান গনির একটি পা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর ২১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে তখনকার ইপিআর সদর দফতরে গিয়ে তাদের কাছে থাকা অস্ত্রগুলো জমা দেন শাহজাহান মিয়া। এর দুদিন পর ২৩ ডিসেম্বর আবার চাকরিতে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য শাহজাহান মিয়াকে পরে বিভাগীয়ভাবে সাব-ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পুলিশ বাহিনী ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট থেকে তাকে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয়। পুলিশের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়ার শেষ আবদার রাষ্ট্রীয় খেতাব পাওয়া।
শাহজাহান মিয়াসহ পুলিশের অনেক মুক্তিযোদ্ধার ঐকান্তিক আগ্রহকে মূল্যায়ন করে ২০১৩ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পুলিশের প্রথম প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সাহসিকতা আর ত্যাগের কথাই এখন এই জাদুঘরের মাধ্যমে জানছে পুলিশের বর্তমান প্রজন্ম। যেখানে শাহাজাহান মিয়া যে বেতার যন্ত্রটি দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর সংবাদ সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই বেতার যন্ত্রটিও এখন পুলিশের এই জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। নয় মাসের রক্ত¶য়ী যুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে পুলিশ সদস্যদের গৌরবোজ্জ্বল ত্যাগকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সবার জন্য এ জাদুঘর উন্মুক্ত রয়েছে।
পুলিশের এই জাদুঘরে শাহাজাহান মিয়ার বেতার যন্ত্রটি ছাড়াও রয়েছে একটি পাগলা ঘণ্টা, যেটি বাজিয়ে ২৫ মার্চ রাতে পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করেছিলেন আরেক কনস্টেবল আব্দুল আলি। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা ও ইউনিফর্মসহ বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং রয়েছে। পুলিশ সদস্যদের উজ্জীবিত করতে দেয়া পুলিশের তখনকার আইজি তছলিম উদ্দিন আহমেদের বেতার ভাষণের কপিও রয়েছে এই জাদুঘরে। জাদুঘরটি আরো বড় পরিসরে করার জন্য রাজারবাগ শহিদ মিনারের পাশেই নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল বিশিষ্ট ভবন।
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কাজ করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবিদা সুলতানা। তিনি বলেন, প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। রাজারবাগ, পিলখানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্নস্থানে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালালেও তারা প্রথম প্রতিরোধের মুখে পড়েন রাজারবাগে। রাজারবাগে পুলিশের প্রতিরোধের সেই বার্তা পৌঁছানোর পরই সারাদেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
আকাশজমিন/এসআর