আকাশজমিন ডেস্ক: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ মালয়েশিয়া। এ দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩২ মিলিয়ন; যার ৬১ শতাংশই মুসলিম। তারপরও বলতে হবে বহুজাতিক ও বহুভাষী মানুষের দেশ মালয়েশিয়া।ফলে মালয়েশিয়ার সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়। জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যে মালয়েশিয়ানদের জন্য ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন। পবিত্র রমজানে এই বন্ধন আরও স্পষ্ট হয়।
রমজানের আগমনের আগে থেকেই তারা এ মাসকে উদযাপনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। সাধারণত রমজান শুরু হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগের জুমার নামাজের আগেই নির্ধারণ করা হয় যে কোন দিন এলাকার সব মুসল্লি একত্র হয়ে মসজিদ ও তার চারপাশের আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করবেন। পরিচ্ছন্নতার এই কাজকে মালয় ভাষায় বলা হয় ‘গোটোং রোয়ং’ অর্থাৎ পারস্পরিক সহযোগিতায় কোনো কাজ করা।
শুধু মসজিদই নয়, ঘরবাড়িও সুন্দরভাবে পরিষ্কার করা হয়। পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমেই শুরু হয় পবিত্র রমজানকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি। এখানকার মুসলমানরা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রতিবছর নানা আয়োজনে রমজান পালন করে থাকেন।
শাহরুন মোবারাকুন
মালয়েশিয়ায় রমজান মাসের আগমনী বার্তা সবার কানে পৌঁছে যায় সাইরেনের শব্দে। ‘শাহরুন মোবারাকুন’ বলে অভিবাদন জানিয়ে এবং উপহার বিনিময় করে শুরুতেই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে মজবুত করে নেয় মালয়েশিয়ানরা। রোজা উপলক্ষ্যে সরকার এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়া হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীতে।
মাসজুড়েই কানায় কানায় পূর্ণ থাকে মসজিদ। তারাবিহসহ অন্য নামাজে নারী ও শিশুদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তারাবি শেষে বিশেষ শিক্ষামূলক আসর বসে মালয়েশিয়ার মসজিদগুলোতে। সাহরির পর ঘুমানোর অভ্যাস নেই মালয়েশিয়ার মুসলমানদের। সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্থানীয় মসজিদে ধর্মীয় আলোচনা শুনে সূর্য উঠলে নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে পড়েন তারা।
রমজানজুড়ে বিশেষ আয়োজন
সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজানকে ঘিরে মালয়েশিয়ায় থাকে বিশেষ আয়োজন; যা চলে মালয়েশিয়ার শাহ আলম, পেনাং, কোয়ান্তান, মেলাকাসহ প্রতিটি রাজ্যে। এমনকি মারদেকা মাঠেও নেওয়া হয় ইফতারের বিশেষ উদ্যোগ।
ফ্রি ইফতার ব্যবস্থা
রমজান মাসে বেশ অতিথিপরায়ন হয়ে ওঠেন মালয়েশিয়ানরা। মসজিদগুলোতে বিনামূল্যে ইফতারির সুযোগ থাকে। মসজিদে মসজিদে ইফতারিতে বিনামূল্যে শরবত ও বুবুর বা নরম খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকে। চাল, মাংস, নারিকেলের দুধ, ঘি ইত্যাদি দিয়ে বুবুর ল্যাম্বাক তৈরি করা হয়। প্রায় পাঁচ দশক যাবত কুয়ালালামপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে খাবারটি বিতরণের প্রচলন চলে আসছে।
এছাড়া সরকারি ও বেসরকারিভাবে ফ্রি ইফতারের ব্যবস্থার কোনো কমতি নেই মালয়েশিয়ায়। ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে এই ফ্রি ইফতার করেন। এ যেন আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার বড় এক আয়োজন।
বাহারি খাবারে ইফতার
মালয়েশিয়ায় স্থানীয়রা বিভিন্ন প্রকারের হাতে বানানো পিঠা, হালুয়া জাতীয় নাশতা, সাদা ভাত, ফলমূলসহ মালয়েশিয়ান খাবার দিয়ে ইফতার করেন। সঙ্গে থাকে আম, তরমুজ, বাঙ্গি, কলা, পেঁপে, আপেল, আঙুর, কমলাসহ নানা রকমের মালয়েশিয়ান ফল।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের রমজান
দেশীয় খাবার ছাড়া ভিনদেশি খাবারে ইফতার জমে না বাংলাদেশিদের। সুদূর প্রবাসে থেকেও তাই তৃপ্তি মেটাতে ইফতারে বাঙালি খাবারই তাদের প্রথম পছন্দ। তাই মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা রমজান পালন করেন অনেকটা দেশীয় আমেজে। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হওয়ায় রমজানে শ্রমিকদের নামাজ পড়ার ও রোজা রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টগুলোতে দেশীয় ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে ইফতারি তৈরি করা হয়।
ইফতারিতে খেজুর, জিলাপি, সরবত, জুস, হালিম, ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, লাচ্চিসহ নানা প্রকারের খাবার রাখা হয়। বাংলাদেশিরা যেখানে থাকেন, সেখানেই একসঙ্গে ইফতার করেন। তাই মালয়েশিয়ানদের পাশাপাশি বাংলাদেশিদের আয়োজনটা বড় হয়। মালয়েশিয়ানরা অভিভূত হয় বাঙালিদের ইফতারির বিশাল আয়োজন দেখে।
ইফতারি বেচাকেনার মেলা
রমজান মাসে প্রতিদিন বিকালে মালয়েশিয়ার পিং-সিটি পুত্রাযায়া, শাহ আলম, মারদেকাসহ প্রায় সব জায়গায় ‘বাজার রমাদান’ নামে ইফতারি বেচাকেনার মেলা বসে। বাজার রমাদানে বিভিন্ন প্রকারের মালয়েশিয়ান খাবারের সমারোহ ঘটে। তবে এসব খাবার প্রবাসী বাঙালিদের খুব একটা টানে না। ইফতারির আসল আইটেমগুলো তারা বাসায় নিজেরা তৈরি করেন বা বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট থেকে কিনে আনেন।
দিনে প্রকাশ্যে খাওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ
রমজানে মুসলমানদের দিনে প্রকাশ্যে খাওয়া মালয়েশিয়ার আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রতি বছর এ অপরাধে আটক হন অনেকে। এছাড়া পুরো রমজানে সরকারি নজরদারিতে জিনিসপত্রের দাম অন্যান্য সময়ের থেকে কম রাখা হয়। ক্রেতাদের জন্য আকর্ষণীয় ছাড় ঘোষণা করে শপিংমলগুলো। রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই শুরু হয়ে যায় কেনাকাটার ধুম।
তারাবিহর নামাজে মুসল্লিদের ঢল
মসজিদে মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করা হয়। এ মাসে মসজিদগুলোতে প্রতি ওয়াক্ত নামাজে মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যায়। দেশটির ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও নামাজ আদায় করতে মসজিদে যান। নামাজের পরে কুরআন তেলাওয়াত করতে পছন্দ করেন মালয়েশিয়ানরা।
রমজান বাজার
সরকারি ঘোষণার পর মালয়েশিয়ায় রমজান বাজারের কার্যক্রম যথারীতি এ বছরের জন্য শুরু হয়েছে। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দুই বছর বাজারটি বন্ধ ছিল।
বাজার পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, রমজান বাজার চালু হওয়ায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিজেদের ইফতারসামগ্রী সেখান থেকে কিনতে শুরু করেছেন। রমজান মাসে পাঁচ হাজার স্টলসহ মোট ৭২টি রমজান বাজারের অবস্থান রাজধানীজুড়ে।
কুয়ালালামপুরের রমজান বাজার
টিটিডিআই, কাম্পং বারু, বাংসার, স্টেডিয়াম শাহ আলম, বুকিত বিনতাং, কেলানা জায়া, মেলাওয়াতী, মসজিদ ইন্ডিয়া, বান্দর তুন রাজাক, এসএস ১৩। যার মধ্যে অধিকাংশ বাজারই প্রতিদিন বিকাল সাড়ে ৪টার মধ্যে শুরু হয়। এরপর গরম গরম সর্বোত্তম খাবার তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন ব্যবসায়ীরা।
মালয়েশিয়ায় সাধারণত শুকনো খাবার বা খেজুর দিয়ে মুসলমানেরা রোজা ভাঙেন। এছাড়া দেশীয় কিছু বিখ্যাত ইফতার আইটেম। মালয় লোকজনের কাছে একটি স্থানীয় ইফতার আইটেমের নাম হচ্ছে ‘বারবুকা পুয়াসা’। এটি আখের রস এবং সোয়াবিনের দুধ দ্বারা তৈরি এক ধরনের বিশেষ মিষ্টান্ন সামগ্রী। এছাড়া মালয়েশিয়ার ইফতারে থাকে নাসি আয়াম, পপিয়া বানাস, আয়াম পেরিক, লেমাক লাঞ্জা ইত্যাদি। সঙ্গে বিভিন্ন স্থানীয় খাবার তো আছেই।
পণ্য ডিসকাউন্টের প্রতিযোগিতা
অবিশ্বাস্য হলেও মালয়েশিয়ায় মূল্য ১ টাকাও না বাড়িয়ে উল্টো পণ্যের দাম কমানোর প্রতিযোগিতায় থাকেন ব্যবসায়ীরা। রমজান আসার আগে ভোজ্যতেল ও চিনি, মাছ, তরকারির যে দাম ছিল, এখনো তেমনই রয়েছে। মালয়েশিয়ায় খোলাবাজারে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি হয় না। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা চেইন সুপারশপ, হাইপার মার্কেটগুলোতে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি হয়।
সরেজমিন সুপারশপ ও হাইপার মার্কেটগুলোতে দেখা গেছে, রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীতে ডিসকাউন্ট স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব সুপারশপ ও হাইপার মার্কেটগুলোর মধ্যে রয়েছে মাইডিন, জায়ান্ট, এনএসকে, ইকোনসেভ, সেগি ফ্রেশ, জায়াগ্রোসারি।
দেশটিতে পণ্যসামগ্রী, খাদ্যসামগ্রী, খাবার হোটেল, মুদি দোকান, চেইন সুপারশপ ও হাইপার মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুণগতমান খুব কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন দেওয়ান বান্ডারায়া কুয়ালালামপুর (ডিবিকেএল) নামে সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নিয়মের কোনো ব্যত্যয় দেখলে গ্রেফতারসহ জেল-জরিমানা করেন তারা। এ বাহিনীর ভয়ে পণ্যের দাম বৃদ্ধি তো দূরের কথা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য রাখাসহ কোনো অনিয়ম করার সাহস পান না ব্যবসায়ীরা। ডিবিকেএল সবসময় বাজারে ইউনিফর্মের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি করায় তাদের ফাঁকি দেওয়া দুঃসাধ্য।
আকাশজমিন/এসআর