সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৫২ পূর্বাহ্ন

মোদীর ফলে কি আদানি, আম্বানি, টাটাদের মতো বৃহৎ সংস্থাগুলির লাভ হচ্ছে?

আকাশজমিন রিপোর্ট:
  • সর্বশেষ আপডেট : শনিবার, ১ এপ্রিল, ২০২৩ ১১:৫৮ pm

আকাশজমিন ডেস্ক:
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ভিরাল আচারিয়া যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের এক নতুন গবেষণা পত্রে দেশের শিল্পনীতি নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারতীয় অর্থনীতিতে বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাধান্য। দেশের বাণিজ্যে বৃহৎ গোষ্ঠীগুলোর বড় অংশীদারিত্ব আছে। কিন্তু এটা অর্থনীতির জন্য ঠিক নয়।‘যদি আমরা চাই যে ভারতে ব্যবসা বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ুক আর বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলো তাদের উৎপাদিত পণ্য বা পরিষেবা বেশি দামে না বিক্রি করে, তাহলে ওই বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর আকার ছোট করতে হবে,’ গবেষণা পত্রে লিখেছেন আচারিয়া। বর্তমানে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের অর্থনীতির অধ্যাপক আচারিয়ার মতে, ১৯৯১ সালে অর্থনীতির উদারীকরণের পর থেকেই ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনসেন্ট্রেশন’ কমে আসছিল।‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনসেন্ট্রেশন’ এমন একটা অবস্থা, যেখানে দেশের মোট উৎপাদনের ওপর কয়েকটি মাত্র সংস্থা আধিপত্য বিস্তার করে ফেলে। তবে ২০১৫ সালের পর থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনসেন্ট্রেশন আবারও বাড়তে শুরু করেছে। রিলায়েন্স, আদানি, টাটা, আদিত্য বিড়লা এবং ভারতী এয়ারটেল– যদি এই পাঁচটি বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠীর ২০২১ সালের অবস্থার দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে যে আর্থিক ক্ষেত্রের বাইরে তাদের সম্পত্তির অংশীদারিত্ব প্রায় ১৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। ১৯৯১ সালে এর পরিমাণ ছিল দশ শতাংশ। ভিরাল আচারিয়া বলছেন, ‘এই সংস্থাগুলো যে শুধু ছোট ছোট সংস্থাকে শেষ করে দিয়ে নিজেরা বড় হয়েছে, তা নয়। এই পাঁচটি সবচেয়ে বড় সংস্থা নিজেদেরও ক্ষতি করেই বড় হয়েছে। বাজারে এই সংস্থা পাঁচটির অংশীদারিত্ব ১৮ শতাংশ থেকে কমে নয় শতাংশ হয় গেছে। আচারিয়ার মতে, এর পেছনে একাধিক কারণ আছে। বড় সংস্থাগুলো যেমন সমস্যায় পড়া ছোট সংস্থা কিনে নেওয়া বা অধিগ্রহণ করার ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষা যেমন একটা কারণ, তেমনই আবার সরকারের পক্ষ থেকে এমনভাবেই শিল্পনীতি তৈরি করা হয়, যাতে বড় সংস্থাগুলোকেই সরকারি প্রকল্পগুলো ভাগ করে দেওয়া যায়। আবার ওই সব বড় সংস্থা তাদের উৎপাদিত পণ্য বা পরিষেবার মূল্য অকল্পনীয়ভাবে কম রাখে, আর সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সাধারণত এসব না দেখার ভান করে।
অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক: ভিরাল আচারিয়া লিখছেন, ‘এই প্রবৃত্তি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম তৈরি হয়, যেখানে রাজনৈতিক সম্পর্ককে ব্যবহার করে ব্যবসায়িক প্রকল্প যোগাড় করে ফেলা যায়।’এই অবস্থায় কর্পোরেট সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরেই বেআইনি লেনদেন হতে থাকে। সরকার বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে সখ্যতা আছে, এমন সংস্থাগুলোকে ব্যাংকও বেশি বেশি করে ঋণ দেয়। সংস্থাগুলো সেই ঋণের অর্থে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়ে চলে, অন্যদিকে প্রতিযোগী সংস্থাগুলোর পক্ষে লড়াইটা অনেক কঠিন হয় দাঁড়ায়। আইএমএফের সাবেক ভারত-প্রধান জোশ ফেলম্যান বিবিসিকে এই প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন সংস্থাগুলো খুব সহজেই ওভার লেভারেজ হয়ে যায়। আর তারপর একটা সময়ে সংস্থাগুলো ধরাশায়ী হয়ে যায়। সম্প্রতি ভারতে আদানি গোষ্ঠীর সম্বন্ধের হিন্ডেনবার্গ প্রতিবেদনে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লেভারেজের ব্যাপারেও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ফেলম্যান বলেছেন, ‘এর ফলে একটি দেশের অর্থনীতির ওপরে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়। বেশ কিছু এশীয় দেশে আমরা এটা হতে দেখেছি। যেমন ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় হয়েছিল।’

অর্থনীতিবিদ নোরিয়েল রোবিনি ফেব্রুয়ারিতে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ভারতে ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়ন’ এবং বৃহৎ ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক পরিবারগুলোর হাতে অর্থনীতির একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।‘এই নীতিতে চলার কারণে ওই সব বৃহৎ ব্যবসায়িক পরিবার নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রটিও দখল করে ফেলেছে আর তা থেকে নিজেরা লাভবান হচ্ছে, লিখেছেন রোবিনি।

‘জাতীয় চ্যাম্পিয়ন’ সংস্থা তৈরির নীতিতে সমস্যা কোথায়?
ভারতে যেভাবে ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়ন’ সংস্থাগুলোকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার নীতি নেওয়া হয়েছে, ১৯৯০ এর দশকে চীন, ইন্দোনেশিয়া আর দক্ষিণ কোরিয়াও একই নীতি নিয়েছিল। এই ধরনের সংস্থাগুলো কোনও পরিবার দ্বারা পরিচালিত বিশালাকার ব্যবসায়িক গোষ্ঠীই হয়ে থাকে। যেমন স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক সংস্থা স্যামসাং একটি পরিবার দ্বারা পরিচালিত গোষ্ঠী। ভিরাল আচারিয়া বলছেন, ‘ভারতের মতো ওই সব দেশগুলো বড় সংস্থাকে রক্ষা করার জন্য বড় মাত্রায় শুল্ক চাপানোর পথে হাঁটেনি।’আবার অন্যদিকে ভারত দেশীয় সংস্থা আর বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোকে বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করতে রক্ষণশীল নীতি আরও বেশি করে চালু করছে। আর এসব নীতির ফলেই বিশ্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে ভারতের উঠে আসার প্রচেষ্টার ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আচারিয়া আর রোবিনি দু’জনই বলছেন, ভারত যদি বিশ্ব বাজারে বড় প্রতিযোগী দেশ হয়ে উঠতে চায়, তাহলে তাদের শুল্ক কমাতে হবে আর ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ বাণিজ্য প্রবণতার সুবিধা নিতে হবে। চায়না প্লাস ওয়ান নীতিতে বৃহৎ সংস্থাগুলো তাদের উৎপাদন কেন্দ্রসমূহ ভারত আর ভিয়েতনামের মতো দেশে সরিয়ে নিতে চায়। ভিরাল আচারিয়ার মতে, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনসেন্ট্রেশন’র প্রভাব দেশীয় অর্থনীতির ওপরে পড়ার সম্ভাবনা আছে। বাজারে ‘বিগ ফাইভ’ সংস্থাগুলোর ক্রমবর্ধমান শক্তি কোর ইনফ্লেশান রেটের হার চড়িয়েই রাখবে। আচারিয়া তার গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘যদিও এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার সুযোগ আছে, তবে এটা তো দেখাই যাচ্ছে যে বাজারে নিজের শক্তি দেখিয়ে কম বিনিয়োগ করে বেশি লাভ ঘরে তোলার প্রবণতার মধ্যে একটা আন্তঃসম্পর্ক তো আছেই। তিনি বলছেন, ভারতের বৃহৎ সংস্থাগুলোর কাছে দাম নির্ধারণের বিশাল ক্ষমতা রয়েছে। এর ফলেই তারা নিজের নিজের শিল্পক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থার থেকে অনেক বেশি লাভবান হয়। দাম নির্ধারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করে বড় সংস্থাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে তাদের উৎপাদিত পণ্য আর পরিষেবার মূল্য কম করে রাখতে পারে, যার ফলে প্রতিযোগী সংস্থাগুলোর বাজারে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়।

তবে অন্য কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বিবিসিকে ওই আন্তঃসম্পর্কের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ফেলম্যান বলছেন, ‘পাঁচটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী যদি নতুন কোনও শিল্পে প্রবেশ করে, তাহলে তারা নিঃসন্দেহে আরও বড় হয়ে উঠবে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে আগে থেকেই যেসব প্রতিযোগী সংস্থা আছে, তারাও বড় হওয়ার সুযোগ পাবে, আর তার ফলে পণ্য বা পরিষেবার দাম কমবে।’উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, রিলায়েন্স গোষ্ঠীর সংস্থা জিও-র টেলিকম ক্ষেত্রে প্রবেশর কথা। তারা ওই ক্ষেত্রে প্রবেশ করতেই অন্যান্য সংস্থাও কিন্তু পরিষেবার দাম অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিল। ব্যাংক অব বড়োদার মুখ্য অর্থনীতিবিদ মদন সবনউইশ আবার মনে করেন, এই তত্ত্বের ‘স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না।’ বিবিসি বাংলা।আকাশজমিন/আরজে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন
আর্কাইভ
© All rights reserved © Akashjomin

Developer Design Host BD