আমাদের ছোটকালে স্কুলের স্যারদের সামনে পড়লে জানা পড়াও ভুলে যেতাম। কোনো কোনো স্যার ক্লাসে পড়া না পারলে বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে হাঁটুর নিচে পায়ে বাড়ি মারতেন। কেন হাঁঁটুর নিচে মারতেন এর কারণ অনেক পরে জেনেছি। বড় হয়ে।
যিনি বা যারা আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তাদের দেখলে ভয়ে গলা তো শুকিয়ে আসতই, তাদের কক্ষের সামনে দিয়ে হেঁটে কোথাও যাওয়ার সাহসও করতাম না। খুব জরুরি হলে অনেকটা পথ ঘুরে গন্তব্যে যেতাম। তবু শিক্ষকদের কক্ষের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সাহস হতো না।
স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসতেন অভিভাবকরা। মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফিস তারাই পরিশোধ করতেন। বই, খাতা, পেন্সিল, কলম তারাই কিনে দিতেন। ক্লাসের স্যার ছাড়া অন্য ক্লাসের স্যারদের সঙ্গে আমাদের দেখা হতো না। তবে সবাই স্যারকে চিনতাম। তারা সামনে পড়ে গেলে পালিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতাম। এর মানে এই নয় যে তাদের শুধু ভয় পেতাম। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই আমার কোনো কথা বা আচরণে যাতে কোনো বেয়াদবি প্রকাশ না হয়ে যায় সেই প্রচেষ্টা থেকেই এমনটি করতাম।
তবে তাদের ভয়ও পেতাম, সেই ভয় ছিল শিক্ষাগুরু হিসেবে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়। কোনো স্যার, আপার জন্য ভীষণ মায়া অনুভব করতাম। কারণ তারা খুব নরম ভাষায় কথা বলতেন, সুন্দর করে পড়া বুঝিয়ে দিতেন। না বুঝলে সমস্যা পরে গিয়ে বুঝে নিতে বলতেন। তাই বলে তারা কেউ সহজ ছিলেন না। স্নেহ, মায়ার আড়ালেও অদৃশ্য এক ব্যক্তিত্বের দেয়াল তোলা থাকত তাদের চারপাশে। সে দেয়াল ভাঙার চেষ্টা আমরা কেউই কখনো করিনি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক— এমন করে এক একটি ধাপ অতিক্রম করেছি আর যখন ওইসব শিক্ষকদের ছেড়ে আসতে হয়েছে তখন তাদের জন্য বুকের ভিতর হাহাকার অনুভব করেছি।
বহু বছর পর যখন কোনো শিক্ষকের সঙ্গে হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে যেত তখন একদল লোকের সামনে মাথা নুইয়ে পায়ের ধুলো নিতে কখনো লজ্জা পাইনি। ইতস্তত করিনি। অনেক শিক্ষক চিনতে পারতেন না। যখন মাথা তুলে পরিচয় দিতাম, একগাল হেসে কী যে আত্মতৃপ্তির হাসি দিতেন। আত্মতৃপ্তিটা এই জন্য যে, তার ছাত্র বা ছাত্রীটি এতদিনেও তাকে মনে রেখেছে। শ্রদ্ধার জায়গায় রেখেছে। শিক্ষক হিসেবে তখন গর্ব হওয়ারই কথা। অনেক শিক্ষক ছিলেন যাদের মার খাওয়ার ভয়ে মুখস্ত পড়া ভুলে যেতাম।
দু’হাত সামনে এগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে সেসব শিক্ষকের জোড়া বেতের কত বাড়ি মেনে নিয়েছি। চোখে পানি চলে আসত। কষ্ট পেতাম। তাই বলে কোনোদিন তাদের অশ্রদ্ধা করার কথা ভাবিনি। অপমান করার কথা মাথায় আসেনি। বাসায় গিয়ে বাবা-মাকে শিক্ষকদের নিয়ে কোনো নালিশ করার কথা ভুলেও মনে করিনি। কারণ জানতাম, শিক্ষকদের নামে কোনো অভিযোগ করার চেষ্টা করলে বাবা-মা আগে আমাকে পেটাবেন এত বড় স্পর্ধা দেখানোর জন্য। তারপর অন্য কথা। বাবা মায়ের পর শিক্ষক হচ্ছেন সেই আপনজন যারা প্রকৃত অর্থেই আমাদের মানুষ করে গড়ে তোলেন। বাবা-মা জন্ম দেন, কিন্তু মানুষ হওয়া যাকে বলে তা গড়েন শিক্ষক। বাবা-মায়ের পর শিক্ষকরাই অভিভাবক— এমন বিশ্বাস বুকে ধারণ করেই বড় হয়েছি।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হঠাৎ করেই বিভিন্ন জেলায় শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানোর হিড়িক পড়েছে। যে পদ্ধতিতে তাদের পদত্যাগ করানো হচ্ছে তা শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জারও। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়ে তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করছে। প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ যে-ই হোন চেয়ার থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে দিচ্ছে। গায়ে হাত তুলছে। গালাগাল করছে। জুতার মালা পরিয়ে দিচ্ছে। নারী বা পুরুষ কোনো শিক্ষকই বাদ যাচ্ছেন না। শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখে শিক্ষকদের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি, ঘৃণার ছাপ। তাদের আচরণ হায়েনার মতো। ফেসবুকে একটা ভিডিও দেখলাম।
শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা ছেলেটি ক্যামেরার সামনে একগাল হেসে বলছে দীপক স্যারকে মেরে সে ভীষণ আনন্দ পেয়েছে। এত আনন্দ যে ভাষায় প্রকাশ করার নয়। এক প্রশ্নের জবাবে বলছে, স্যারের মাথায় সে থাপ্পড় মেরেছে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখি। বলে কী ছেলেটি? সে কী জানে কী জঘন্য কাজ করেছে? কেউ কী তাকে বলেছে, কাজটি সে ভালো করেনি বা তার উচিত শিক্ষকের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া? ছোটকালে শুনেছি, শিক্ষকের মনে কষ্ট দিলে জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। অভিশাপ লাগে। সে অভিশাপ কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়। এখনকার বাবা-মা তাদের সন্তানকে মনে হয় এসব কথা বলে সতর্ক করেন না।
শিক্ষকদের সবাই যে আদর্শ শিক্ষক এ কথা বলার সুযোগ নেই। তাদের অনেকে নানাভাবে তাদের সম্মানের জায়গা থেকে সরে এসেছেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না করে কোচিং সেন্টার খুলে সেখানে ছাত্রছাত্রীকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেছেন। কেউ যদি কোচিংয়ে না পড়তে চায় তাকে পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়ার বা ফেল করিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। নিজের বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ধরে রাখতে পরীক্ষার আগে ছাত্রছাত্রীদের হাতে প্রশ্নপত্র পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
একইভাবে অভিভাবকরাও এসব শিক্ষকদের প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। তারা প্রতিবাদ করেননি। অর্থের অহমিকায় প্রথম শ্রেণিতে পড়া সন্তানকেও প্রাইভেট টিউটর দিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করে। সন্তানকে শিখিয়েছেন, পড়ো। নাক কান, ঘাড় গুঁজে শুধু পড়। ঘাড় তোলার দরকার নেই। ভালো রেজাল্ট করতে হবে। বড় পদে চাকরি করতে হবে। অনেক টাকা কামাই করতে হবে। সমাজে একক আধিপত্য ধরে রাখতে হবে।
এমনকি সহপাঠীদের সঙ্গে প্রতিদিনের টিফিন শেয়ার করতেও শেখাননি। বাসা থেকে বক্সটি ব্যাগে ভরে দেয়ার সময় বারবার বলে দিয়েছেন, সে যেন সবটুকু খেয়ে নেয়। বক্স যেন ভরা অবস্থায় ফেরত না আসে। আরো বলেছেন, সে-ই যেন পুরো টিফিন খায়। বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন শেয়ার করে যেন বক্স খালি করে নিয়ে না আসে। এভাবেই বড় করেছেন, করছেন সন্তানকে।
তাদের নীতি আদর্শ মানবতা কিছু শেখাননি। শিক্ষক কে, শিক্ষকের মর্যাদা কী সেটাও শেখাননি। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের সফল সমাপ্তির পর একজন মা তার সন্তানকে সিগারেট কিনে দিয়েছেন। এ রকম একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়েছে। সেখানে সিগারেট কিনে দিতে পেরে মায়ের গর্বিত হাসি আর ছেলের সিগারেট টেনে হাওয়ায় ধোঁয়া ছড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য দেখে সভ্য মানুষ মাত্র ঘৃণা প্রকাশ করবে। একজন মায়ের ভুল ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এ রকম আরো মা, আরো বাবা সমাজের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব নয়।
আমি একটি পরিবারকে জানতাম। সেই পরিবারের যিনি কর্ত্রী তিনি একদিন গর্ব করে বলছিলেন, পরিবারে কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান হলে তার স্বামী বক্স ভর্তি তরল পানীয় বাসায় নিয়ে আসেন। ছেলেদেরটা আলাদা, আর তাদেরটা আলাদা। ছেলেরা তাদেরা কক্ষে বন্ধুদের নিয়ে রাতভর সেই তরল পানীয় পান করে আর তারা বড়রা আরেকটা কক্ষে পান করেন। এ কথা বলে তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন তাদের কাছে পান করা খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। এতে তারা মনে কিছু করেন না। এই কিছু মনে না করার কারণে তার ছেলেরা কেউ মানুষ হয়নি। নানা মামলার আসামি এখন তারা। ধরা পড়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে।
আমি অনেক আগে একটা লেখায় বলার চেষ্টা করেছিলাম, শিক্ষক, বিচারক, চিকিৎসক এবং সাংবাদিক— এদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে নেই। থাকা উচিত নয়। লেজুড়বৃত্তি তো অনেক পরের কথা। ব্যক্তির রাজনৈতিক পছন্দ অবশ্যই থাকবে। কিন্তু কোনোভাবেই তা প্রকাশ্য নয়। কারণ এ চারটি পেশার মানুষের ভূমিকার ওপর সমাজের আদর্শ, নীতি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক জড়িত। আবার তাদের ভুল ভূমিকায় সব রসাতলেও যায়। গত কয়েক বছরে আমরা তো সেটাই প্রত্যক্ষ করেছি। এ পেশার মানুষগুলো তাদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে নিজেদের সম্মান নষ্ট করেছেন, সমাজকে-রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিয়েছেন।
একজন তার টাইমলাইনে প্রশ্ন তুলেছেন, শিক্ষকদের দুর্নীতি নিয়ে যারা এত সোচ্চার তারা তাদের বাবা-মা স্বজনদের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়েও সমান সোচ্চার তো? যদি তোমাদের বাবা-মা দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত হন তাদেরও এভাবে অপমান, লাঞ্ছিত করতে পারবে তো? জুতার মালা গলায় ঝুলিয়ে ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে দিতে পারবে তো?
যিনি প্রশ্নটি করেছেন তিনি নিশ্চয়ই শিক্ষকদের অপমানিত হওয়ার দৃশ্য দেখে দুঃখে কষ্টে এ প্রশ্নটি তুলেছেন। কারো কাছ থেকে এর জবাব মিলবে এমন আশাও করি না। সেইসঙ্গে এটাও প্রত্যাশা করি না তারা তাদের অভিভাবকদের লাঞ্ছিত করুক। তবে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করে, অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে, তাদের গায়ে হাত তোলার যে স্পর্ধা কিছু শিক্ষার্থী পেয়েছে এর কুফল অন্তর অব্দি ঠেকবে না এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।
তবে আজকের এ পরিস্থিতির জন্য শুধুই কী ছাত্রছাত্রীরা দায়ী? এর পেছনে কেউ কী নেই? স্বীয় স্বার্থ বাস্তবায়নে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে না তো কেউ? বিশেষ একটি দলের সমর্থন করাই কী এসব শিক্ষকের অপরাধ? এমন প্রশ্নও কিন্তু উঠেছে। কোনো শিক্ষকের কোনো অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের নয়। তারা যা করছে এটা অন্যায়, গর্হিত অপরাধ। অভিভাবকদের দায়িত্ব এ বিষয়ে সন্তানদের সতর্ক করা। তাদের বোঝাতে হবে হুজুগে বেপরোয়া হয়ে আজ যে তারা শিক্ষককে অপমান, অপদস্ত করছে, আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই হবে— শিক্ষকরা নয়।
লেখক: সাবিরা ইসলাম
সাংবাদিক, গল্পকার
আকাশজমিন/আরআর