সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:২৭ পূর্বাহ্ন

গলা কাটছে হার্টের রিং

আকাশজমিন রিপোর্ট:
  • সর্বশেষ আপডেট : মঙ্গলবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৩ ১২:৩০ am

আকাশজমিন প্রতিবেদক: চাঁদপুর থেকে হার্টের সমস্যা নিয়ে গত ১০ জানুয়ারি রাজধানী ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে এসেছিলেন এরামত খান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার হার্টে একটি ব্লক ধরা পড়ে। হৃদরোগ চিকিৎসক দ্রুত হার্টে রিং পরানোর পরামর্শ দেন। এ চিকিৎসায় ব্যয় হয় আড়াই লাখ টাকা। শুধু রিংয়ের দাম ৭৩ হাজার টাকা।

রোগীর ছেলে ফারুক খান বলেন, ‌‘গত ১১ জানুয়ারি ১০ জন ডাক্তার আমাকে ঘিরে ধরেন। তারা বলেন, আপনার বাবার হার্টের অবস্থা ভালো নয়। ১০০ ভাগ ব্লক পাওয়া গেছে। এরপর একটি কাগজে সই নিয়ে বাবাকে দ্রুত ক্যাথল্যাবে নেয়া হয়।’ হার্টের রিং নিয়ে দরদাম করেছেন কিনা জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‌দরদামের সুযোগ পেলাম কোথায়? অন্য হাসপাতাল বা কোম্পানির রিং ব্যবহার করা যাবে না বলে চিকিৎসক আগেই জানিয়ে দেন।

এ হাসপাতালে দুটি ক্যাথল্যাব রয়েছে, সেখানে গড়ে প্রতিদিন ২০ জনের বেশি রোগীকে রিং পরানো হয়। সব রোগীর কাছ থেকেই রিংয়ের জন্য অতিরিক্ত অর্থ রাখা হয় বলে জানা গেছে।

এ অনৈতিক বাণিজ্য বন্ধে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২০১৭ সালে রিংয়ের সর্বনিম্ন মূল্য ২৫ হাজার এবং সর্বোচ্চ মূল্য ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। নির্ধারিত মূল্য তালিকা হাসপাতালে টানানোর নির্দেশনাও দেয় সংস্থাটি। তবে বর্তমানে এ হার্টের রিং রোগীদের কাছে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রিং বিক্রির ব্যবস্থা নেই। ভারতে এই রিংয়ের সর্বনিম্ন খুচরা মূল্য ৮ হাজার ৯২৯ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার ৮০৪ টাকা।

১০ জন রোগী এবং কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু কমিশন বাণিজ্যের কারণে রোগীর স্বজনদের বেশি দামের রিং পরাতে উৎসাহিত করে থাকেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা। ১ লাখ টাকার রিংয়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা কমিশন পান চিকিৎসক। পেসমেকার, ভাল্‌ভ, এপিজেনেরেটিক্স যন্ত্র থেকেও চিকিৎসকরা কমিশন পান বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ হাসপাতালে হার্টের চিকিৎসার জন্য ভালো বিশেষজ্ঞ নেই। সার্জারি চিকিৎসক আবু হাসান বাশার, মুনজুর রহমান ফোহাদকে দিয়ে হার্টে রিং পরানো হয়। এটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং আইনের পরিপন্থি।

এ হাসপাতালের মতোই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে এমন অনৈতিক রিং বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রিনলাইফ হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্ন, সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, লুবনা হাসপাতাল, রাজধানীর গুলশান-২ এর একটি অভিজাত হাসপাতাল, পান্থপথে অবস্থিত বিআরবি হাসপাতালসহ এই এলাকায় তিন থেকে চারটি হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা হার্টের চিকিৎসা ঘিরে এমন বাণিজ্য সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।

হৃদরোগ ছাড়াও এসব হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরা ভুল চিকিৎসা ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। চিকিৎসার অবহেলায় রোগীর মৃত্যু, বেশি বিল আদায়, বিলের জন্য মরদেহ আটকে রাখা, রোগ নির্ণয়ে নিম্নমানের রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ ইকো মেশিন, ক্যাথল্যাবে যন্ত্রপাতি সংকটসহ বহু অভিযোগ এসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে। ক্যাথল্যাবে ভেন্টিলেশন সুবিধা না থাকা, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ও পরী¶াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এসব বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। তবে অধিকাংশ ¶েত্রেই চাপ দিয়ে সমঝোতা করা হয়। আবার অনেকেই আইনি ঝামেলায় যেতে চান না।

এসব হাসপাতালে বিভিন্ন রিং সরবরাহ কোম্পানির প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলেও তারা রোগীর স্বজনের কাছে এ যন্ত্র বিক্রি করেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জিএমই গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজার বলেন, কোনো কোম্পানিই রোগীর স্বজনের কাছে রিং বিক্রি করে না। চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতাল থেকেই কিনতে হয়। আমাদের হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি থাকে। চাহিদা অনুযায়ী রিং সরবরাহ করে থাকি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে এমন ঘটনা অপ্রত্যাশিত। এজন্য সরকারের নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, কমিশন বাণিজ্য ডাক্তারদের স্বভাব নষ্ট করে দিয়েছে। আগে কেবল ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা প্যাথলজিক্যাল টেস্ট থেকে কমিশন দেয়া হতো, ওষুধ কোম্পানি থেকে দেয়া হতো গিফট। এখন একশ্রেণির কার্ডিওলজিস্ট রীতিমতো রিং থেকেও কমিশন খান, যা শুনে আমরাই লজ্জিত। প্রতিনিয়ত ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে।

রিং পরান টেকনিশিয়ান : রাজধানীর সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাইনুল মুন্না নামের টেকনিশিয়ান দিয়ে হার্টের রিং পরানোর অভিযোগ উঠেছে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে টেকনিশিয়ান পদে কর্মরত। সিরাজুল মেডিকেলে ক্যাথল্যাব প্রতিষ্ঠা থেকেই ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

জানা গেছে, রোগীর হার্টে রিং বসানোর সময় তিনি চিকিৎসকের সঙ্গে ক্যাথল্যাবে অবস্থান করেন। মাঝে মধ্যে নিজেই রোগীর শরীরে রিং পরান। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা অনেক ঝুঁকির কাজ। এতে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেন এ টেকনিশিয়ান।

এই হাসপাতালে হৃদরোগের পাঁচজন চিকিৎসক বসেন। এর বাইরেও ১০ থেকে ১২ জন চিকিৎসক এই হাসপাতালে ক্যাথল্যাব ভাড়া নিয়ে রোগীর হার্টে রিং পরান। এখানে ইচ্ছামতো টাকা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতাল মালিক ও এসব চিকিৎসকের সঙ্গে চুক্তি করে চলছে রিং বাণিজ্য। অনেক সময় রোগীরা রিংয়ের দাম নিয়ে অন্ধকারে থেকে যাচ্ছেন।

 

আকাশজমিন/এসআর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন
আর্কাইভ
© All rights reserved © Akashjomin

Developer Design Host BD