আকাশজমিন ডেস্কঃ
শুধু নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি কিংবা প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় নয়, বরং এ ধরনের দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় ক্ষতি থেকে নগরবাসীকে বাঁচাতে খাল-জলাশয় বড় ভূমিকা পালন করে। ঢাকার খাল নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। নগর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় খালের ভূমিকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময় বলে আসছি নগরীর জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়ও খাল-বিল-জলাশয়ের প্রয়োজন আছে। পুরান ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় একসময় বড় বড় পুকুর ছিল। গত ৫০ বছরে ৯৬টি পুকুর উধাও হয়ে গেছে এ এলাকা থেকে। পুরান ঢাকায় ২৪টি পুকুরের অস্তিত্ব বর্তমানে থাকলেও আকারে তা অনেক ছোট হয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো পুকুর দখলের পাঁয়তারা এখনো চলছে। পুরান ঢাকার ওইসব পুকুর রক্ষায় কখনই জোরালো কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি সরকারি কোনো সংস্থা। বর্তমানে রাজধানীতে ৩২৭টি জলাশয় রয়েছে। এগুলো রক্ষা করতে না পারলে এ শহরে জলাধার থাকবে না। আমরা মনে করি, দখলের কারণে আয়তনে ছোট হয়ে যাওয়া পুকুরের ভূমি উদ্ধার করে হলেও তা সচল রাখা উচিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘পুরান ঢাকার মতো দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় অবশ্যই একাধিক বড় জলাশয় থাকা উচিত। গরমের সময় খাল বা জলাশয় তাপমাত্রা শুষে নেয়, বর্ষায় জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজে দেবে, নগরজীবনে প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি এসব জলাশয়ে মানুষ মাছ ধরবে, সাঁতার কাটবে, গোসল করবে। কিন্তু আমাদের কথা কেউ আমলে নেয় না। কোনো একটা দুর্যোগ ঘটলে সবাই লেখালেখি করে, বলাবলি করে, কয়দিন পর দেখা যায় আগের যেই অবস্থা ছিল তাই রয়েছে।’ রাজধানীর গুলিস্তানের বঙ্গবাজারে গতকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীর দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এতে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন প্রায় ৫০ হাজার দোকান কর্মচারী। ঈদের আগে এমন দুর্ঘটনায় বিশাল ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্যবসায়ী পরিবারগুলো। প্রত্যক্ষদর্শী ও মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই যদি পানি দেয়া যেত, তাহলে হয়তো সহজেই আগুন নেভানো সম্ভব হতো। অন্তত ক্ষতির পরিমাণ এতটা ব্যাপক হতো না। কিন্তু আশপাশে কোনো জলাধার বা পানির উৎস না থাকায় সময়ের ব্যবধানে পুরো এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীতে পর্যাপ্ত জলাধার না থাকায় যেকোনো অগ্নিদুর্ঘটনার সময়ই ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। অবিলম্বে সিটি করপোরেশনকে জলাধারের পরিমাণ বাড়ানোর দাবিও জানিয়েছেন নগর বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, এক দশক আগেও বঙ্গবাজারের এক কিলোমিটার এলাকার মধ্যে অন্তত ছয়টি বড় খাল ছিল, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভরাট হয়ে যায়। ছয়টি খালের মধ্যে ছিল সেগুনবাগিচা খাল, নারিন্দা খাল, ধোলাইখাল, গোপীবাগ খাল, দেবদোলাইখাল ও সূত্রাপুর খাল। এ ছয়টি খালের বাইরে দোলাই নামে একটা নদীও ছিল বঙ্গবাজারের খুব কাছেই। বিভিন্ন অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে এসব খাল ও জলাধার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এতে প্রয়োজনের সময় মেলে না পানি। গতকাল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের ভয়াবহতা বঙ্গবাজার থেকে ক্রমান্বয়ে আশপাশের মার্কেটগুলোয় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ সময় ব্যবসায়ীরা দিগিবদিক ছুটতে থাকেন। ব্যবসায়ীরা জানান, ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি তারাও আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিতে চেয়েছেন। কিন্তু আশপাশের কোথাও পানি না পাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। একাধিক স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গেও কথা বলে জানা যায়, পানির অভাবে তারা আগুন নেভাতে পারেননি। আবুল কালাম নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ‘আমরা যে পাইপ ধরি সে পাইপেই পানি নেই। ফায়ার সার্ভিস বলে পানির চাপ পাওয়া যাচ্ছে না।’ইকবাল বাহার নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘যেভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, এটা এত বাড়ত না। শুরুতেই যদি পানি দেয়া যেত তাহলে পুরো বঙ্গবাজার মার্কেট পুড়ে ছাই হতো না।দুপুরের দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আগ মুহূর্তে আগুন নেভানোর জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল ও দোকানিরা মিলে বিভিন্ন আকারের কনটেইনার ও বালতিতে পানি ভরে নির্বাপণের কাজে অংশ নেন। ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানির বাড়তি অংশ এ সময় তারা কাজে লাগান। সে সময় তারা অভিযোগ করে বলছিলেন, আশপাশে একটি পুকুর বা খাল থাকলে এ রকম দিন হয়তো তাদের দেখতে হতো না।
ঢাকার খাল নিয়ে বিভিন্ন সংস্থার নথিপত্র ঘেঁটে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক দশক আগেও বঙ্গবাজারের এক কিলোমিটারের মধ্যে বড় যে ছয়টি খাল ছিল তা ভরাট করে ফেলা হয়েছে বিভিন্ন অবকাঠামোগত কারণে। এর মধ্যে ধোলাইখাল-২ অন্যতম। বর্তমানে এখানে সিটি করপোরেশনের রাস্তা ও মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। খালটি বুড়িগঙ্গা নদী থেকে উত্পত্তি হয়ে সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, দয়াগঞ্জ, ওয়ারী হয়ে দয়াগঞ্জ বাজার পর্যন্ত ছিল। খালটির একটি অংশ পুরান ঢাকার বেগমগঞ্জ, রায়সাহেব বাজার ও বাবুবাজার দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে মিলেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সূত্রমতে, একসময় সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ধোলাইখাল এখন ৯০০ মিটারে এসে ঠেকেছে। সিটি করপোরেশনের ৪১ খালের তালিকায় এটি থাকলেও আদতে ধোলাইখাল এখন কেবলই ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ সরু ডোবা, যেটিকে খাল বলে চেনার আর কোনো উপায়ই নেই।
একইভাবে নারিন্দা থেকে ধোলাইখাল পর্যন্ত নারিন্দা খাল। সেটিও আজ পুরোপুরি বিলীন। এদিকে বিজয়নগর পানির ট্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত আরামবাগ খাল এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গোপীবাগ পর্যন্ত ছিল গোপীবাগ খাল। সেখানে এখন বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বক্স কালভার্টের মাধ্যমে সেগুনবাগিচা খালকেও মেরে ফেলা হয়েছে।
এসব খালের বিষয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এসব খালে নৌকা চলেছে, জেলেরা মাছ ধরেছে, এসব দৃশ্য চোখে দেখেছে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। মূলত নব্বইয়ের দশকের পরপর সেগুনবাগিচা, গোপীবাগ ও আরামবাগ খাল ভরাট হয়ে যায়। ২০১০ সালের আগেও ধোলাইখাল, নারিন্দা খাল ও দেবদোলাইখাল ও সূত্রাপুর খালের অস্তিত্ব ছিল। ঢাকার জমির দাম বেড়ে গেলে দ্রুত খালগুলো ভরাট হয়ে আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হতে থাকে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘নগরীর খালগুলো যে কেবল ভরাট হয়ে গেছে তা তো নয়, নগরীর খালগুলো ক্রমাগত ভরাট হচ্ছে। এখন যে কটা অবশিষ্ট আছে সেগুলোও ভরাট করা হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে এ নগরটাকে হত্যা করেছি। এখন এ নগর আমাদের ওপর শোধ নিচ্ছে। ঠিক ফায়ার ব্রিগেডের কাছাকাছি থাকা বঙ্গবাজারেরই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে গোটা ঢাকা শহর তো আসলে অগ্ন্যুৎপাতের ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের যারা নগর কর্তৃপক্ষ, যারা নগরপিতা, তারা কি দয়া করে একসঙ্গে বসে এ নগরীর নীল আর সবুজ হারিয়ে যাওয়াকে আদৌ থামাবেন?
আকাশজমিন/আরজে