তাসলিমা আক্তার মিতু,কিশোরগঞ্জ: ইতিহাস সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে কিশোরগঞ্জের এগারসিন্দুর ইউনিয়ন একটি প্রাচীন এলাকা। তবে সেই অতীত দিনের গৌরব বিলীন হয়ে মাটির সাথে প্রায় মিশে যাচ্ছে।কিশোরগঞ্জের এগারসিন্দুর দুর্গ ছিল ঈসা খাঁর শক্ত ঘাঁটি।লাল মাটি, সবুজ শীতল আর ঐতিহাসিক বিভিন্ন নিদর্শনে সমৃদ্ধ এই জনপদের প্রায় সর্বত্র এখনও জাফরি ইট,মাটির তৈরী পাত্রের ভগ্নাংশ, পাথর খন্ড ও দুর্গের বিশাল আকৃতির স্থাপনার ধংসস্তুপ চোখে পড়বে।
প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়,পঞ্চদশ শতাব্দীতে এগারসিন্দুরে সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র তৈরী হতো।প্রচুর ফলমূল ও পানেরও চাষ হতো।মূলত মসলিন বস্ত্র তৈরীর জন্যই তৎকালে ইংরেজ ও পর্তুগীজরা কুঠি স্থাপন করেছিল এগারসিন্দুর গ্রামে।বাণিজ্যিক ভারতীয় উপমহদেশে বাংলার স্বাধীনতা বীজ একমাত্র ঈশা খাঁ বপন করেছিলেন।তৎকালীন সময়ে মোঘল ও ইংরেজদের কবল থেকে বাংলাকে রক্ষা করতে বাংলার জমিদারদের আমন্ত্রণে ১৪শত ঘোড়া,২১টি নৌবহর ও পর্যাপ্ত গোলাবারুদ নিয়ে আফগানিস্তান থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে এসে পৌঁছেছিলেন।
ত্রিপুরা রাজ্য থেকে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি ও সোনারগাঁও দখল করেছিলেন যা আজও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।বারো ভূঁইয়া ঈসা খাঁ মোঘল সুবেদার শাহবাজ খাঁ কে রণচাতুরীতে পরাজিত করে ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে রাজধানী স্থাপন করে এবং আধিপত্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন।সেই সময় ঈসা খাঁ সোনারগাঁও-এ মোঘলদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সৈন্যসামন্তসহ এগারসিন্দুর দুর্গ আক্রমণ করেন। বেবুদ কোচরাজকে পরাজিত করে দুর্গ দখল করেন এবং একে দূর্গটিকে শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেন।মোঘল বাদশাহ আকবরের সেনাপতি মানসিংহ ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্গ আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু ঈসা খাঁ সেই যুদ্ধে মানসিংহকে পরাজিত করে। ঈশা খাঁর সাথে যুদ্ধে মান সিংহের তলোয়ার ভেঙ্গে যায় তখন নিরস্ত্র মানসিংহকে ঈশা খাঁ নতুন অস্ত্র তুলে দেন। ঈসা খাঁর এই মহান মানবিকতায় মানসিংহ পরাজয় মেনে নেন।
১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈসা খাঁর মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরেও এগারসিন্দুরের গৌরবগাঁথা বস্ত্র শিল্প,জমজমাট নৌবন্দর,ব্যবসাকেন্দ্র,ধর্মপ্রচারক পীর আউলিয়া ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাসস্থান হিসেবে এগারসিন্দুর গ্রামের সুনাম অক্ষুণ্ণ ছিল কিন্তু সম্রাট শাহজাহানের আমলে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে অহমরাজ প্রায় ৫শত যুদ্ধযান সহ ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে এসে এগারসিন্দুর দুর্গ লুট সহ বন্দরে আক্রমণ করে বন্দর ধংস করে দেয়।এই সংবাদ পেয়ে বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁ সৈন্য নিয়ে অহমরাজের সাথে যুদ্ধ শুরু করে এবং এই যুদ্ধে বন্দরটি আরও ধংসস্তূপে পরিণত হয়।পরবর্তীকালে অহমরাজের বাকী যা স্মৃতিচিহ্ন ছিল সেগুলোও ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভূমিকম্পে মাটির সাথে মিশে যায়।এভাবেই একদিনের কোলাহলমূখর জনপদ ও সমৃদ্ধশালী বন্দর ও দুর্গের ঐতিহাসিক স্থাপনা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
২০২১ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ঈশা খাঁর দুর্গে খনন কার্যক্রম চালায়। এই খননে পাওয়া গেছে প্রায় দুইশত পঞ্চাশ পিস প্রাচীন তৈজসপত্রের নিদর্শন ও স্থাপত্য কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ। উদ্ধার করা বস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে জীবাশ্ম, প্রস্তরখণ্ড, পোড়ামাটির হাঁড়ি-পাতিল, ঘটিবাটি, থালা, পিরিচ, মাটির কলসের ভাঙা অংশ, তৈলপ্রদীপ, প্রদীপদানি, অলংকৃত ইট, ব্রেসলেট, হাতের বালা, সিরামিক, পোড়ামাটির বল, পুতুল, টয় প্রভৃতি। আরো মিলেছে ইটের তৈরি বর্গাকৃতির প্রতিরক্ষা দেয়াল, জলাধার, চুন-সুরকির মেঝে ও ব্রিক সলিংয়ের নিদর্শন।এগুলো উদ্ধারের পরই মাটি খননে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরে সংরক্ষিত করা হয়েছে।পুনরায় গর্ত ভরাট করে দুর্গ মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।বর্তমানে এইখানে শুধু মাটির ঢিবি দেখা মিলবে।
দুর্গের চারপাশে প্রাচীন মাটির ঢিবি ও চৌকোনা ইটের ভাঙা টুকরার স্তূপ। দুর্গ চত্বরে প্রাচীন ইটের কংক্রিট পড়ে আছে এবং উপরিভাগে কবরসদৃশ একটি পাকা স্থাপনা রয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, এটি শাহ গরীবুল্লাহ আউলিয়ার মাজার। দুর্গের দেয়াল ঘেঁষে বড় একটি পুকুর ও কিছুটা দূরে রয়েছে মরা শঙ্খ নদ।একটি মাটির উঁচু ঢিবি ছাড়া দুর্গের কাঠামোগত কোন চিহ্নই বর্তমানে নেই।
আকাশজমিন/এসআর