মোঃহেলাল মিয়া:
বাংলাদেশের বেশিরভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো না কোনো বিভাগে সবসময় সেশনজট লেগেই থাকে। জুলাই বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন করে সেশনজট সৃষ্টি হয়েছে। এই নতুন সেশনজট সৃষ্টির পেছনে জুলাই বিপ্লব যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা।কারণ জুলাই বিপ্লবের আগে, অর্থাৎ জুন মাসে,শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সার্বজনীন পেনশন প্রত্যাখ্যান,সুপার গ্রেড,আলাদা বেতন কাঠামোর জন্য তারা বিভিন্ন আল্টিমেটামের পাশাপাশি ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনসহ সকল একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ফলস্বরূপ,শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারায় তাদের সেমিস্টার গুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি।
জুলাই মাসে সরকারের দমন-পীড়নের মধ্যে কোটা আন্দোলন সৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই সময় শিক্ষার্থীদের ডাকে সাড়া দিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন।সেই আন্দোলনের ফলে এক সময় ছাত্র-জনতার চাপে ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের সহযোগীরা ৩৬ জুলাই, অর্থাৎ গত ৫ আগস্ট, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপর একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্য ও অন্যান্য কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
জুলাই বিপ্লবের পর ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অভিষেকের মাধ্যমে দেশ নতুন করে বিকশিত হতে শুরু করেছে। জুলাই বিপ্লব ও বিপ্লব-পরবর্তী সময়কে মিলিয়ে মোট দুই মাসের কিছু বেশি সময় শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষার বাইরে ছিলেন।দেশ যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল হঠাৎ সে সময় দেশে আকস্মিক ভারতীয় বন্যার সৃষ্টি হলে শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।গত ৫ ই আগস্টের আগে ও পরে শিক্ষার্থীদের অবদান নিঃসন্দেহে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
দেশকে ফ্যাসিস্ট ও তাদের সহযোগীদের থেকে মুক্ত করতে যে ২-৩ মাস শিক্ষা কার্যক্রমের ক্ষতি হয়েছে, তা কে পূরণ করবে? যদি শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি পূরণ না করা হয়,তাহলে ভবিষ্যতে ন্যায়ের জন্য কোনো আন্দোলন সংগ্রামের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা কতটা সাড়া দেবে,সে বিষয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হয়।বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি সেশনজট শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পারে,তাহলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পারছে না? অবশ্যই সেখানে সদিচ্ছা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ঘটিয়েছে দেশের জন্য,দেশের মানুষের জন্য। তাহলে দেশ কেন সংকটকালীন সময়ে সৃষ্ট সেশনজট নিরসনে ব্যবস্থা নেবে না? শিক্ষার্থীরা আন্দোলন সংগ্রাম করে ফ্যাসিস্ট রেজিমের পতন ঘটাতে গিয়ে প্রায় দু’মাস সেশনজট তৈরি করেছে, কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের পেনশনের দাবিতে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে ইতিহাসের অন্যতম ব্যর্থ আন্দোলনের ফলে তৈরি করা সেশনজটের দায় শিক্ষার্থীদের কেন নিতে হবে,তা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।বলা যায় যে,শিক্ষার্থীদের কঠোর আন্দোলনের ফলে তৎকালীন সরকার শিক্ষকদের আন্দোলন নিষ্পত্তি করেন কিন্তু শিক্ষকদের আন্দোলনে নয়।
রাষ্ট্র সংস্কার করতে গিয়ে যদি ভবিষ্যতের রাষ্ট্রের কর্ণধারদের সেশনজট তৈরি হয়, তা কখনোই আশার ইঙ্গিত বহন করে না বরং হতাশার সৃষ্টি করে।যেহেতু শিক্ষকরা পাঠদান বন্ধ করে তাদের পেনশনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন, তাই নতুন করে সৃষ্ট সেশনজটের দায় তাঁদেরই নিতে হবে।বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা ও ইউজিসি কর্তৃক দ্রুত দেশের বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সৃষ্ট সেশনজট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো নানা অজুহাত দেখিয়ে সেটি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেবে না বরং আরও জট তৈরি করতে পারে,কারণ ফ্যাসিস্টদের দীর্ঘ শাসনামলে তাদের মদদপুষ্ট অনেক ব্যক্তি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চ পদে বহাল রয়েছেন।তারা সেশনজট নিরসনের পরিবর্তে জট দীর্ঘায়িত করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও তাদের সহযোগীদের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনে কাজ করতে পারেন বলে ধারণা করা হয়।
জুলাই বিপ্লবে ছাত্রলীগের যে নেতাকর্মীরা নিরস্ত্র শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর হামলা করেছিলেন,তাদের বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িতকরণ এবং পুনর্বাসনের ফলে সেমিস্টারের সময়সীমা পিছিয়ে যেতে পারে।এতে করে বিপ্লবী শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং তাদের পরিবার ও ভবিষ্যৎও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ ও তাদের সহযোগী অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীদের বিচার করতে হলে সেমিস্টারের সময়সীমা কমিয়ে এনে দ্রুত তা বাস্তবায়ন করতে হবে,যাতে বিপ্লবে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা স্বস্তি পান।
যদি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সেশনজট নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়,তবে সন্ত্রাসীরা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তায়নের জন্ম দিতে পারে,যা ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের জন্য অশনিসংকেত হবে।শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করে দিলে ভবিষ্যতে আবারও দেশের প্রয়োজনে রাজপথে নামতে শিক্ষার্থীরা প্রস্তুত থাকবেন। শিক্ষার্থীদের তিরস্কারের স্বরূপ সেশনজট তৈরি না করে, জুলাই বিপ্লবের বিপ্লবী নায়কদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে পুরস্কার হিসেবে সেশনজট নিরসন করে যথাসময়ে কোর্স শেষ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন বিকশিত হবে,তেমনি নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষার ফলে তাদের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা কেটে যাবে এবং সুষ্ঠুভাবে শিক্ষা কার্যক্রমও সময়মতো শেষ হবে।পাশাপাশি সন্ত্রাসীরা আর তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করতে পারবে না।
বিটিসিলএফ,বেরোবি শাখা।
আকাশজমিন/আআর