রিয়াদুল ইসলাম রিয়াদ, বাঁশখালী (চট্রগ্রাম) প্রতিনিধি
দেশের অন্যতম লবণ উৎপাদনশীল চট্রগ্রামমের উপজেলা বাঁশখালী। আর এই উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদনের ধুম পড়েছে। চলতি মৌসুমে বাঁশখালীর ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু লবণের দাম কম হওয়ায় হতাশায় ভোগছেন চাষিরা। লবণের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। বর্তমানে ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে কাঁচা লবণ। তাতে উৎপাদন খরচের চেয়ে বিক্রিমূল্য কম হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন বাঁশখালীর ২৫ হাজার লবণ চাষি।
জানা যায়, ‘বাঁশখালী উপজেলার খানখানাবাদ, বাহারছড়া, শেখেরখীল, কাথরিয়া, সরল, গণ্ডামারা, চাম্বল, পুঁইছড়ি এবং ছনুয়া উপকূলীয় এলাকার ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে লবণ চাষ করা হচ্ছে। প্রায় ২৫ হাজার কৃষক এই মৌসুমে লবণ উৎপাদন করছেন। তাতে গত মৌসুমের মতো ৮০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই মৌসুমে প্রতি কানি জমি লিজ (বর্গা) হয়েছে ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়। চাষিরা নিজেদের জমি, বা লিজ নিয়ে এই লবণ চাষ করছেন। অনেকে আবার জমি মালিকের সাথে ভাগাভাগিতে চাষ করছেন। পাইকারি প্রতিমণ লবণ ২৫০ থেকে ২৭০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। সরকারি সহায়তা ও তদারকির না থাকায় মিল মালিক ও মহাজনরা চাষিদের কাছ থেকে কম দামে লবণ কিনে তা পরে উচ্চমূল্যে বাজারজাত করছেন।'
বিসিক (বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্র) ও লবণ চাষিদের তথ্য অনুযায়ী, বাঁশখালীতে চলতি মৌসুমে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে ২৫ হাজার লবণচাষি লবণ উৎপাদন করছেন। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদিত হতে পারে।
হাজার হাজার মণ লবণ অবিক্রীত: গত মৌসুমে লবণ উৎপাদনে চাষিরা ভালো টাকা পাওয়ায় মাঠের লাগিয়ত এবার ৫ গুণেরও বেশি বেড়েছে। শ্রমিকের পারিশ্রমিকসহ অন্যান্য খরচও বেড়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় উল্টো লবণের দাম কমেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। তাতে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় চাষিরা হাজার হাজার মণ লবণ বিক্রি না করে গর্তে করে রাখতেছেন। এতে কয়েক লক্ষ মণ লবণ অবিক্রীত রয়েছে।'
লবণ আমদানি বন্ধের দাবি: অভিযোগ উঠেছে, সরকারের পক্ষ থেকে লবণের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত না করায় কিছু মিল মালিক স্থানীয় মধ্যস্বত্বভোগীর সঙ্গে সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। এতে উপজেলার হাজার হাজার প্রান্তিক চাষিসহ লবণ উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অন্তত ৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ কস্টিক সোডা উৎপাদনের নাম দিয়ে বন্ড কমিশনারের আওতায় ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করা হচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের কারণে লবণ চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এই কারণে প্রান্তিক চাষিরা অবিলম্বে লবণ আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়ে লবণের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।'
বিসিকের বাঁশখালী উপজেলার কর্মকর্তা আনসারুল করিম জানান, ‘বাঁশখালী ও কক্সবাজারে এবার চাহিদার চেয়ে ২ লক্ষ টন লবণ বেশি উৎপাদন হতে পারে। বর্তমান বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক লবণ উৎপাদন হচ্ছে। ডলার সংকট ও ব্যাংকে এলসি খুলতে না পারায় লবণের দাম একটু কম। লবণ মাঠের বর্গা ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় চাষীরা একটু হতাশ। আশা করি চাষীরা লবণের ন্যায্যমূল্য পাবেন। এছাড়া চলতি মৌসুমে দেশে লবণ উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করতে একাধিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। বিদেশ থেকে যাতে লবণ আমদানি করতে না হয় সে লক্ষ্যে চলতি মৌসুমে দেশজুড়ে ৮০ হাজার একর জমিতে ২৬ লক্ষ মেট্রিক টন পরিশোধিত লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।’
লবণ চাষীরা জানায়, ‘এই মৌসুমের শুরু থেকে লবণের দাম কমতেছে। অথচ অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এই মৌসুমে জমির লাগিয়ত ৫ গুণেরও বেশি বেড়েছে। এছাড়া পলিথিন খরচ, পানির স্কীম খরচ, মাঠ ভাঙা ও শ্রমিক খরচ মিলিয়ে কানি প্রতি ৫০ হাজার টাকারও বেশি খরচ হচ্ছে। অথচ লবণ প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছেন ২৫০ টাকায়। তারমধ্যে প্রতি মণ লবণের শ্রমিক ধুলাই খরচ ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। বর্তমানে হাজার হাজার টন লবণ অবিক্রীত রয়েছে। তাতে কিস্তির টাকা ও দাদনের টাকা শোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার লবণচাষী। লবণের ন্যায্য মূল্যে না পেলে লবণ চাষীরা পথে বসবে।'
বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের চরপাড়া এলাকার লবণ চাষি জাকের হোসেন বলেন, ‘প্রতি কানি (৪০ শতক) ৩০ হাজার টাকা করে ৬ কানি জমি নিয়ে লবণ উৎপাদনে মাঠে নামি। পলিথিন, শ্রমিকের মজুরি, লবণ উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণসহ কানি প্রতি খরচ ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। অথচ এক কানি জমিতে ২০০ থেকে ৩০০ মণ লবণ উৎপাদন হয়। প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে খরচ হয় ২৬০ থেকে ২৯০ টাকা। কিন্তু প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৭০ টাকায়। এরকম হলে আমরা লবণ চাষীরা ভিখারি হয়ে যাবো।'
গণ্ডামারার আরেক লবণ চাষী মো. আবদু রহিম বলেন, ‘আমি একজন প্রবাসী। আমি প্রবাসী হলেও প্রতি বছর ১০০ কানি জমি লিজ নিয়ে শ্রমিকদের সাথে চুক্তিভিত্তিক লবণ উৎপাদন করি। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন করেছি, কিন্তু লবণের মূল্য কমে যাওয়ায় হাজার টন লবণ গর্তে করে রেখে দিয়েছি। এ বছরও দেখি লবণের দাম কম। আমার শত শত মণ লবণ অবিক্রীত রয়েছে। লোকসান দিয়ে লবণ বিক্রি করতে চাই না। অন্তর্বতীকালীন সরকার দেশের সব কিছু সংস্কার করলেও লবণের মূল্য নিশ্চিত করতে পারেনি।’
ছনুয়ার লবণ চাষী আহমেদ উল্লাহ বলেন, ‘গত মৌসুমে লবণের মণ প্রতি মূল্য ছিল-৪০০-৪৫০ টাকা। এবার সেই লবণ বিক্রি হচ্ছে ২৭০ টাকায়। তবে চাষীরা পাচ্ছেন মাত্র ২৩০-২৪০ টাকা। বাকি অংশ দালাল সিন্ডিকেট লুটে নিচ্ছে। এছাড়া পলিথিনের উচ্চ মূল্য, জমি বর্গার কঠিন শর্ত এবং বাজারের অব্যবস্থাপনার কারণে আমরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছি। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানায়, অন্তত ভালো মূল্য না হলেও লবণের ন্যায্য মূল্যটা পায়।'
গণ্ডামারা লবণ উৎপাদনকারী সমিতির সহ-সভাপতি ওসমান গণী বলেন, ‘অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় এ মৌসুমে লবণের দাম খুবই কম। ডলার সংকট ও ব্যাংকের এলসি খুলতে না পারার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা লবণের দাম কমিয়ে দিয়েছে। লবণ চাষীদের জমি বর্গা, ধুলাই খরচ, পানির স্কীম, পলিথিন ও শ্রমিক খরচসহ মণ প্রতি ৩০০ টাকা উৎপাদন খরচ হচ্ছে। লবণচাষীরা অতিরিক্ত লোকসানে। হাজার হাজার টন লবণ অবিক্রীত রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে চাষীরা পথে বসবে। সরকারের প্রতি অনুরোধ যাতে লবণের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করে।'
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোখতার হোছাইন সিকদার বলেন, ‘লবণের ন্যায্য মূল্যে লবণ চাষীদের অধিকার। অথচ লবণচাষীরা ব্যাপক লোকসানে। উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার মানুষের পরিবার লবণ চাষের উপর নির্ভরশীল৷ অথচ লবণের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে হাজার হাজার লবণচাষী। সরকারের কাছে লবণের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জোর দাবি জানাই।'